নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান গত বছর জুলাইয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর জন্য চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এ কথা জানিয়েছেন বাড্ডা থানার এসআই মো: গোলাম কিবরিয়া খান।
এসআই কিবরিয়া গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমার নাম এসআই মো: গোলাম কিবরিয়া খান। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রামপুরা থানায় কর্মরত ছিলাম। আমি থানার অপারেটরের মাধ্যমে জানতে পারি যে, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান স্যার আন্দোলন দমন করার জন্য হাঁটু গেড়ে বসে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দু’জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চতুর্থ দিনের সাক্ষ্য-জেরা শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১০ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন ধার্য করেন। অপর সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এসআই কিবরিয়া আরো জানান, ‘১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা ২টায়, রামপুরার বিটিভি ভবনের ৩ নম্বর এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়। এর ফলে রামপুরা থানার পাশের বনশ্রী জামে মসজিদের কাছে নাদিম নামে এক ব্যক্তি নিহত হন এবং মায়া ইসলাম নামে একজন নিহত হন। মুসা খান নামে একটি শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়।’
এসআই কিবরিয়া আরো জানান, পরবর্তীতে ‘২১ অথবা ২২ জুলাই ২০২৪ তারিখে, পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান রামপুরা থানায় এসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ভূমিকা রাখার জন্য অফিসার ইনচার্জ মহোদয়ের কাছে এক লাখ টাকা নগদ পুরস্কার প্রদান করেন।’
এসআই কিবরিয়া বলেন, ‘ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার পর, সংযোগ সচল হলে রামপুরা থানা ভবনের পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদের কার্নিশে ঝুলন্ত অবস্থায় এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে গুলি করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।’
ভিডিওটি পরবর্তীতে ২৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে রামপুরা থানায় একটি মিটিংয়ে প্রদর্শন করা হয়, যেখানে উপস্থিত সবাই ভিডিওতে এসআই তরিকুল ইসলাম ভূইয়া এবং এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে ওই ঝুলন্ত ব্যক্তিকে গুলি করতে দেখা যায়। এ সময় এসআই কিবরিয়া আসামির ডকে বসে থাকা এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে শনাক্ত করেন।’
এছাড়া, আদালতে চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে ভিডিওর সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিচারকার্যক্রম চলছে।
এই মামলায় গতকাল ষষ্ঠ সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন তদন্ত সংস্থার সহকারী লাইব্রেরিয়ান কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিক। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাদের জেরা করেন পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেফতার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। এখন পর্যন্ত এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ছয়জন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
এর আগে সোমবার তৃতীয়-চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শহীদ মো: নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা ও প্রত্যক্ষদর্শী মো: ইয়াকুব। জবানবন্দীতে গত বছরের ১৯ জুলাই রামপুরার বনশ্রীতে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো নৃশংস-নির্মমতার কথা ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন। একইসাথে ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচার চান তারা।
গত ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দেন গুলিবিদ্ধ বাসিত খান মুসার বাবা মো: মোস্তাফিজুর রহমান। জবানবন্দীতে ১৯ জুলাই তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। নিজের চোখের সামনেই তার একমাত্র ছেলে মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। একই বুলেটে শহীদ হন মা মায়া ইসলাম। বাচ্চা ছেলেটি বেঁচে থাকলেও কথা বলতে পারছে না। ফলে তছনছ হয়ে যায় তাদের পরিবারের সব স্বপ্ন। ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন চঞ্চল।
এ মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। অন্য আসামিরা হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো: রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো: মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
গত ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। গত ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি।
ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির।
কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়ে এক পুলিশ সদস্য। এতে তিন তলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই দিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ।
এছাড়া, একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মায়া ইসলাম নিহত হন। একইসাথে মায়া ইসলামের ছয় বছর বয়সী নাতি বাসিত খান মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলে এখনো কথা বলতে পারছে না এই শিশু।
গত ২৬ জানুয়ারি রাতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাবেক এএসআই চঞ্চল সরকারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল। এর নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা।



