জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

কুয়াকাটায় বিলীন হচ্ছে দর্শনীয় স্থান

কুয়াকাটার পশ্চিম পাশে মেরিন ড্রাইভ সড়কের এক হাজার ৩০০ মিটার এরই মধ্যে ভেঙে গেছে। ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে আছে জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকায়। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে পর্যটন পুলিশ বক্স, ট্যুরিজম পার্ক, মসজিদ, মন্দির এবং জাতীয় উদ্যানের এক-তৃতীয়াংশ।

হুমায়ুন কবীর, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
Printed Edition
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভাঙন, নষ্ট হচ্ছে সৈকতের সৌন্দর্য
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভাঙন, নষ্ট হচ্ছে সৈকতের সৌন্দর্য |নয়া দিগন্ত

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সমুদ্রসৈকত ও পর্যটন কেন্দ্র আজ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় বিলীন হচ্ছে দর্শনীয় স্থান। সাগরের ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির চাপ, অতিরিক্ত জোয়ার এবং উপকূলীয় দুর্যোগের ফলে এই সৈকতের সৌন্দর্য, অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি প্রভাব পড়ছে এ পর্যটন কেন্দ্রে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুলসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের ঢেউয়ের শক্তি বেড়ে গেছে। এর ফলে শুধু সৌন্দর্যই নষ্ট হচ্ছে না, কুয়াকাটা সৈকতের ভূগোলই বদলে যাচ্ছে।

পর্যটনকর্মী কে এম বাচ্চ বলেন, নয়, এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা, পর্যটন শিল্প সবই হুমকির মুখে। তাই কুয়াকাটাকে রক্ষা করা কেবল পর্যটন নয়, উপকূলীয় অঞ্চলের জীবিকা ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যও অপরিহার্য। তাই সময়ের দাবি, সঠিক সিদ্ধান্ত আর প্রকল্প বাস্তবায়ন না করতে পারলে অচিরেই কুয়াকাটার অস্তিত্ব বিলিন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল আকার ধারণ করবে। গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে সমুদ্রসৈকতের পাড় ভেঙে ক্রমে লোকালয়ের দিকে এগিয়ে আসছে সাগর। এরই মধ্যে কুয়াকাটার প্রায় তিন বর্গকিলোমিটার এলাকা সাগরে চলে গেছে। বিলীন হয়েছে শত শত গাছ, নারিকেল বাগান, জাতীয় উদ্যান, হোটেল, রেস্ট হাউজসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সাগর ভাঙনের তাণ্ডবে সৈকতের অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে। তবুও নেয়া হয়নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

কুয়াকাটার পশ্চিম পাশে মেরিন ড্রাইভ সড়কের এক হাজার ৩০০ মিটার এরই মধ্যে ভেঙে গেছে। ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে আছে জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকায়। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে পর্যটন পুলিশ বক্স, ট্যুরিজম পার্ক, মসজিদ, মন্দির এবং জাতীয় উদ্যানের এক-তৃতীয়াংশ। একসময় যেখানে ছিল বিস্তীর্ণ ঝাউবন, তালগাছ আর নারিকেল বাগান, এখন সেখানে শুধুই রড বের হয়ে থাকা ভাঙা প্রাচীর আর ধ্বংসাবশেষ। সাগরের ঢেউ ধুয়ে নিচ্ছে জনপদের ভেতর। স্থানীয়রা বলছেন, এখন আর সাগর ভাঙে না, সাগর চলে আসে ঘরের দরজায়।

ভাঙন রোধে ২০১৮ সাল থেকে চারবার সৈকত রক্ষা প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে ঢাকায়। প্রতিটি প্রকল্পই পরিকল্পনা কমিশন থেকে ফেরত এসেছে নানা কারণ দেখিয়ে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসে ৭৫৯ কোটি টাকার ‘শোরলাইন প্রতিরক্ষা প্রকল্প’ জমা দেয়া হয়। যেখানে ১১.৭ কিমি এলাকাজুড়ে ৬৮টি গ্রোইন বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে তিনবার প্রকল্প ফেরত আসায় চতুর্থবারের প্রকল্প পাস ও বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে জনমনে। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ আলম জানিয়েছেন, কমিশনের শর্ত অনুযায়ী সংশোধন করে প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে, অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।

সাগরের এ ভয়ঙ্কর ভাঙনের মুখে পর্যটন এরিয়া যেমন হুমকির মুখে। তেমনি দিশেহারা সাগর পাড়ের ব্যবসায়ীরাও। পর্যটন হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, সরকারের এমন কোনো মন্ত্রণালয় নেই যেখানে আমরা আবেদন করিনি। হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে। সাগরের ভাঙন রোধে কেন এতদিনেও ব্যবস্থা নেয়া হলো না। বিখ্যত এ পর্যটন কেন্দ্র রাক্ষা করা সরকারের কি দায়িত্ব নয়? কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সৈয়দ ফারুক বলেন, আগে বেড়িবাঁধ থেকে সৈকতে যেতে ৪০ মিনিট লাগত। এখন সাগর এসে ঠেকেছে বেড়িবাঁধে। এভাবে চলতে থাকলে তো কুয়াকাটাই থাকবে না!

২০২৫ সালের ২৬ জুলাই সর্বশেষ ভাঙনে মেরিন ড্রাইভ ধসে যাওয়ার পর হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেন সাগর পাড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে আসেন বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কায়সার। এ সময় ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার প্রশ্ন রাখেন, সরকার কি চায় না যে কুয়াকাটা টিকে থাকুক? দেশের একমাত্র সমুদ্রসৈকত, যেখানে একসাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে পর্যটক সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে কুয়াকাটাকে রক্ষা করতে হলে দ্রুত বাস্তবভিত্তিক, টেকসই সমুদ্র প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার দাবি স্থানীয়দের।