বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত সপ্তাহে যখন যুক্তরাজ্য সফর করেন, সেই সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার তাকে সাক্ষাৎ দেননি। বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস।
যুক্তরাজ্যের সাহায্য কমে যাওয়া এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের অভিযোগ নিয়েও প্রশ্ন এসেছে বিবিসির সাথে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারে।
প্রকৃতি ও পরিবেশে অবদানের জন্য অধ্যাপক ইউনূস ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
যুক্তরাজ্য সফরে গত ১২ জুন তিনি যখন ওই পুরস্কার নিতে যান, এর আগে বিবিসির সাংবাদিক রাজিনি বৈদ্যনাথন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাক্ষাৎকার নেন।
সেই সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ প্রচার হয়েছে বিবিসির ‘দ্য ওয়ার্ল্ড টুনাইট’ অনুষ্ঠানে। বিবিসির সাথে ইংরেজিতে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে তুলে ধরা হলো-
বিবিসি : এটি আপনার আনুষ্ঠানিক সফর, কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সাথে কেন কোনো সাক্ষাৎ হয়নি?
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস : তার সাথে বৈঠক হলে আমরা খুব খুশি হতাম, সম্ভবত তিনি ব্যস্ত আছেন বা অন্য কিছু হতে পারে। কিন্তু এটি আমার জন্যও একটি দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে, এখন তিনি ব্যস্ত, আমি তাকে বাংলাদেশে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। তখন আমাদের হাতে সময় থাকবে এবং আমরা এখানে (বাংলাদেশে) কী ঘটেছিল, আমরা কী করতে চাইছি তা দেখাতে পারবো এবং তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পারবেন। এবং আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
এটি একটি অনন্য জিনিস, যেখানে আপনি অতীতকে বাদ দিয়ে একটি নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
বিবিসি : আমি এটা জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আপনি বলছেন তিনি (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) ব্যস্ত, অথচ আপনি প্রধান উপদেষ্টা, রাজনৈতিক ভাবে আপনারা দু’জনেই সমান পদমর্যাদার। যুক্তরাজ্যে প্রায় দশ লাখ বাংলাদেশী আছে। বাংলাদেশী সংস্কৃতি ব্রিটিশ জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে, আপনি কতটা হতাশ যে আপনি কয়েক দিন ধরে যুক্তরাজ্যে আছেন, অথচ এই কয়েক দিনের মধ্যেও তিনি আপনার জন্য সময় বের করতে পারলেন না?
অধ্যাপক ইউনূস : আমি জানি না আমার হতাশ হওয়া উচিত, নাকি তার হতাশ হওয়া উচিত। সুযোগটা কোন কারণে হাতছাড়া হয়ে গেছে, আমি জানি না।
সে জন্যই আমি বলছি, বাংলাদেশে তার আসাটা একটা দারুণ সুযোগ হতে পারে, ধীরে সুস্থে বাংলাদেশকে দেখার, অনুভব করার এবং তা উপলব্ধি করার জন্য ভালো সুযোগ তৈরি হতে পারে যে- বাংলাদেশ কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বিবিসি : ডাউনিং স্ট্রিট কেন এ বৈঠকের আয়োজন করল না, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে?
অধ্যাপক ইউনূস : আমার মনে হয় না যে, আমরা এ ধরনের কোনো ব্যাখ্যা পেয়েছি; সম্ভবত তিনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যস্ত।
বিবিসি : কিয়ের স্টারমারের এমপিদের একজন, লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে একটু কথা বলি। অবশ্যই, তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নী। বাংলাদেশের আদালত তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি গ্রহণের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন, যা তিনি অস্বীকার করেছেন। আমরা একটি চিঠি দেখেছি, যেখানে তিনি আপনাকে লিখেছেন, আপনি এখানে থাকাকালীন তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। আপনি কি তার সাথে দেখা করবেন?
অধ্যাপক ইউনূস : না, দেখা করব না। কারণ এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। আমি আইনি প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চাই না। প্রক্রিয়াটি চলতে থাকুক।
বিবিসি : যুক্তরাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের মানবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে এবং তাকে খালাস দিয়েছে। টিউলিপ সিদ্দিকও দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। এরপরও কেন দুদক এখনো তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে?
অধ্যাপক ইউনূস : এটি আদালতের বিষয়, আদালতের বিষয়ে আদলত সিদ্ধান্ত নেবে যে মামলাটির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত আছে কি-না, এর প্রক্রিয়া চালু থাকবে নাকি বাতিল করা হবে।
বিবিসি : কিন্তু আপনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা, আপনি এসেই বলেছিলেন দুর্নীতি নির্মূল করতে চান। তাই আমি আবারো প্রশ্নটি করছি, কারণ দুদকের প্রধান বলছেন যে, এটি কোনো ভিত্তিহীন তদন্ত নয়। আমি এখানে তার উদ্ধৃতিটিই তুলে ধরছি, ‘তিনি বলেছেন অভিযোগগুলো কোনোভাবেই কাউকে লক্ষ্যবস্তু করে নয় এবং ভিত্তিহীন নয়।’ এরপরও টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তারা কোনো প্রমাণ দেখতে পাননি এবং এ তদন্তের কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি দুদক তার সাথে কোনো কথাও বলেনি।
অধ্যাপক ইউনূস : চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় আইনজীবীদের সামনাসামনি আসতে হয়, একত্রিত হতে হয় এবং একে অপরের সাথে তথ্য বিনিময় করতে হয়।
বিবিসি : তিনি (টিউলিপ সিদ্দিকি) বলছেন যে, এখানে তেমনটি হয়নি।
অধ্যাপক ইউনূস : এখনও তো খুব বেশি দেরি হয়নি, আইনিপ্রক্রিয়া সর্বদা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশ তো অস্বীকার করেনি, বলেনি যে আমরা আপনাকে কিছু দেবো না। তাহলেই না কোনো আইনিপ্রক্রিয়া হবে না। কোর্টই এটি সিদ্ধান্ত নিবে।
বিবিসি : কিন্তু এই নির্দিষ্ট অভিযোগে তাকে গ্রেফতারের জন্য ইতোমধ্যেই একটি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) ও তার আইনজীবী স্পষ্টভাবে বলছেন যে, গ্রেফতারি পরোয়ানার পুরো প্রক্রিয়াটিই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও গোলমেলে এবং মিজ সিদ্দিক আরো বলেন যে, তিনি বা তার আইনজীবীদের সাথেও কেউ যোগাযোগ করেনি।
অধ্যাপক ইউনূস : দেখুন, এটি আইনজীবী বনাম আইনজীবীদের তর্ক, আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবীরা এ প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর দিতে পারেন।
বিবিসি : অবশ্যই, কিন্তু আমি প্রশ্নটি আরেকটু সহজভাবে করতে চাইছি, তিনি বলছেন যে তার আইনজীবীদের সাথে দুদকের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়নি এবং তিনি বলছেন যে, এতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।
অধ্যাপক ইউনূস : তাহলে এখানে দুর্নীতি দমনের আইনজীবীরা ব্যাখ্যা করবেন যে কিভাবে এই আইনি প্রক্রিয়া কাজ করে।
বিবিসি : আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আপনি কি এখন আপনার দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো স্বচ্ছ হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন? আপনি কি এখন ‘অন রেকর্ডে’ এটি বলবেন যে, তাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তথ্য সরবরাহ করা উচিত, যাতে এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে কোনো সন্দেহ না থাকে, যা টিউলিপ সিদ্দিক অস্বীকার করছেন?
অধ্যাপক ইউনূস : প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে, তারা সঠিক কাজটি করছে।
বিবিসি : অবশ্যই, টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, যেমনটি আমরা আলোচনা করেছি। যদি এই অভিযোগের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়, এরপর কি আপনি তাকে প্রত্যর্পণও করতে চাইবেন?
অধ্যাপক ইউনূস : আবারো বলছি, এটি আইনিপ্রক্রিয়া। এটি এমন একটি বিষয় যা ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। একটি ধাপের পর আরেক ধাপ।
বিবিসি : এটাই তাহলে প্রক্রিয়ার অংশ?
অধ্যাপক ইউনূস : যদি এটা আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তাহলে অবশ্যই তাই।
বিবিসি : তাহলে, যথেষ্ট প্রমাণ থাকলে, দুদক তাকে প্রত্যর্পণের জন্য আবেদন করতে পারে।
অধ্যাপক ইউনূস : যদি আইন অনুসারে তা প্রয়োজন হয়।
বিবিসি : বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের সাহায্যের শীর্ষ ১০টি সহায়তা প্রাপ্ত দেশের একটি। আমরা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের ব্যয় পর্যালোচনায় শুনেছি যে, বাজেট অনুসারে বৈদেশিক সাহায্য নাটকীয়ভাবে হ্রাস করা হবে। এটি বাংলাদেশের জনগণের ওপর কিভাবে প্রভাব ফেলবে?
অধ্যাপক ইউনূস : প্রথমত, আমরা আমাদের এই সঙ্কটকালীন সময়ে কিছু সাহায্য পেলে খুব খুশি হবো। কিন্তু যদি তা না পাই, তবুও আমরা আমাদের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।
বিবিসি : এটা কতটা ধাক্কা, অধ্যাপক?
অধ্যাপক ইউনূস : এটা কতটা বড় ধাক্কা? আসলে এটা জীবনের একটা অংশ, যেখানে উত্থান-পতন চলতে থাকে। আজ সহায়তা কমেছে, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কাল বাড়বে। পরিস্থিতি যাচাই করে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। যেমন, হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম যে ইউএসএআইডি সহায়তা ১০০ শতাংশ বন্ধ করে দিয়েছে।
আমরা দেখতে পাই যে আমাদের দেশে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটছে, এর মধ্যে আছে আমাদের রোহিঙ্গা সমস্যা। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সব অর্থ কেটে ফেলা হয়েছে। একেবারে শূন্য! পুরো রোহিঙ্গা সমস্যা হঠাৎ আমাদের জন্য আরো প্রকট হয়ে উঠলো। এত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের এটি মোকাবেলা করতে হবে। সহায়তার অর্থ উধাও হয়ে যেতে পারে, কিন্তু রোহিঙ্গারা তো উধাও হয়নি।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারে টিউলিপ সিদ্দিকির সম্পর্কে করা মন্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে বিবিসি মিজ টিউলিপের সাথে যোগাযোগ করেছিল।
জবাবে টিউলিপ সিদ্দিক একটি লিখিত বিবৃতি পাঠান।
তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আমি হতাশ যে অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস তার সফরের সময় আমার সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কল্পনাপ্রসূত অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন, যার কোনো প্রমাণ গণমাধ্যমের কাছেও উপস্থাপন করা হয়নি।’
‘আমি আশা করি, তিনি এখন সংবাদমাধ্যমে আমার বদনাম ছড়ানোর অভ্যাস বন্ধ করবেন এবং আদালতে এটি প্রমাণের সুযোগ দেবেন যে, আমার বিরুদ্ধে তাদের চলমান তদন্তের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’