কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ আগুন

চার দিকে ধ্বংসস্তূপ হাহাকার নিঃস্ব পরিবারগুলো

এস এম মিন্টু
Printed Edition

কড়াইল বস্তিতে যে ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, সেই ঘরে ছিলেন হোসনে আরা বেগম। আগুন লাগার পর গতকাল পর্যন্ত তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। মাকে খুঁজতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ধ্বংস্তূপের মধ্যে মাকে খুঁজতে থাকেন ছেলে শুক্কুর আলী। গত মঙ্গলবার বিকেলে কড়াইল বস্তির আগুনে পুড়ে গেছে প্রায় দুই হাজার ঘর। সেই সাথে পুড়েছে হোসনে আরা বেগমের ঘরও। তবে তার সন্ধান মেলেনি গতকাল পর্যন্ত। পোড়া ঘরগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী সব হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। গত শুক্রবার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক না কাটতেই কড়াইল বস্তির আগুনের লেলিহান শিখায় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বস্তিবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় ঘনবসতিপূর্ণ কড়াইল বস্তি। মহাখালী-গুলশানের আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর কড়াইলের টিনের চালের জরাজীর্ণ খুপরি ঘরের মাঝখানে ব্যবধান শুধু একটি লেকের। তবে সামান্য দূরত্বের আড়ালে লুকিয়ে জীবনমানের আসমান-জমিন পার্থক্য, ক্ষমতার অশুভ আঁতাত ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন বেচা মানুষগুলোর বারবার জ্বলে-পুড়ে নিঃস্ব হওয়ার আখ্যান। মঙ্গলবার ও বুধবার রাতে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। খাবার ও পানি সঙ্কটের পাশাপাশি সাহায্যের হাতও যেন অপ্রতুল। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও তাদের সন্তানরা এক কাপড়েই দিন পার করেছে।

এ দিকে কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

পাঁচ সদস্যের কমিটি নিম্নরূপ : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেন্স) মো: মামুনুর রশিদকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদস্য হিসেবে রয়েছেন- ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ঢাকা জোন-২-এর উপসহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা; মো: নাজিম উদ্দিন সরকার, সিনিয়র স্টেশন অফিসার, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, তেজগাঁও; মো: সোহরাব হোসেন, ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সদস্যসচিব হিসেবে আছেন সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান।

গতকাল কড়াইল বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, বস্তির যেখানে আগুনের ঘটনা ঘটেছে সেই জায়গাটির নাম বৌবাজার মাজারগলি কুমিল্লাপট্টি। দুপুরের রোদে আগুনে পুড়ে বিধ্বস্ত ঘরগুলোর ওপর ছাই উড়তে দেখা গেছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে পোড়া গন্ধে। দুপুরে ধ্বংসস্তূপের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটানা মাকে খুঁজে ফিরছেন শুক্কুর আলী। কখনো আগুনে পোড়া ঘরের ভেতর ঢুকে দেখছেন, কখনো স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘আপনারা আমার মাকে কি কেউ দেখেছেন?’

এলাকাবাসী জানায়, শুক্কুরের মায়ের নাম হোসনে আরা। এলাকাজুড়ে সবাই ‘ধনী’ নামে চিনতেন তাকে। আগুন লাগার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ। ‘ধনী’র স্বামী মিন্টুর ঘর থেকেই সেই রাতের ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আগুন চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ দৌড়ে পালাতে থাকে। কেউ বের হতে পারে, কেউ আর পারেনি। সেই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই হোসনে আরা কোথায় হারিয়ে গেলেন এখনো কেউ কিছু বলতে পারছে না।

করাইল বস্তিতে আগুনে পুড়ে সর্বস্ব হারানো বাসিন্দারা নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভয়াবহ আগুনে এককাপড়ে জীবন বাঁচাতে বের হয়ে গেছে অধিকাংশ পরিবার। ফলে সারা জীবনের কষ্টার্জিত আয়ে গড়ে তোলা আসবাবপত্র, ঘরে থাকা নগদ টাকা, স্বর্ণাঙ্কারসহ কোনো মালামলাই রক্ষা করতে পারেননি। মঙ্গলবারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত এমন পরিবারও রয়েছে, যারা ওই বস্তিতে যতবার আগুন লেগেছে ততবারই সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বারবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও সর্বনাশা আগুন সব কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করেছে। কড়াইল বস্তির আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে সাহায্যের আশায়। অনেকের জ্বলছে না চুলো। শীতের মধ্যে পরিবারগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় বস্তির বৌবাজার অংশে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ততক্ষণে পাঁচ হাজার পরিবারের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বস্তিতে। ঝুঁকিপূর্ণ আগুনে বৌবাজার ইউনিটের পুরো অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও জামালের বাজার ইউনিটের আংশিক পুড়েছে। ৯ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা বস্তিতে কমপক্ষে তিন লাখ লোকের বসবাস।

গতকাল কথা হয় করাইল বস্তির জামালের বাজার ইউনিট অংশে মাওলানা মো: উল্লাহ দারুল নাজাত মহিলা মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মাওলানা মো: উল্লাহর সাথে। তিনি বলেন, তিনি বনানীতে একটি মসজিদে নামাজ পড়ান। এক বছর আগে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা ব্যয় করে মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেন গড়ে তোলেন। বস্তির নিম্ন আয়ের মানুষের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। ৩৬ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিধি আরো এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত মঙ্গলবার ভয়াবহ আগুনে পুরো মাদরাসাটি পুড়ে গেছে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নয়, আগুনে বস্তির বৌবাজার ইউনিট এবং জামালের বাজারের ইউনিটের পাঁচ পরিবার পুরো নিঃস্ব হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আগুন যখন লাগে তখন শিক্ষকরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো রকমে বের হয়ে যান। মাদরাসার আসবাবপত্র রক্ষার চেয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জীবন রক্ষায় প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে মাদরাসার কোনোকিছুই রক্ষা করতে পারেননি। মাদরাসাটি বহু কষ্টে দান অনুদানের টাকায় গড়েছেন। এখন মাদরাসাটি আবার কিভাবে নতুনভাবে গড়বেন সে চিন্তায় আছেন।

একই বস্তিতে গত ২০ বছর ধরে জয়নালের ঘরে ভাড়া থাকেন শারমিন বেগম। স্বামী আজাহার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে অল্প বেতনে চাকরি করেন। সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে শারমিনও চাকরি নেন একটি গার্মেন্ট কারখানায়। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় আপাতত চাকরি করেন না। গত মঙ্গলবার আগুন লাগার খবরে তিনি ঘর থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে যান। চোখের সামনে সাজানো-গোছানো সংসারের সব আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

শারমিন জানান, ২০০৪ ও ২০১৭ সালে লাগা আগুনেও শারমিন নিঃস্ব হয়েছিলেন। সেই দুই আগুনে দু’বার ঘুরে দাঁড়িয়ে এবার আবার একইভাবে সবকিছু হারিয়ে এখন পথের ফকির। গত কয়েক বছরে স্বামী-স্ত্রীর চাকরির টাকায় সংসারে যত আসবাসপত্র গড়েছেন সব পুড়ে গেছে। আরেক ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা বেগমও চাকরি করেন গার্মেন্টে । স্বামী কাজি মিয়া একটি কোম্পানির এক কর্মকর্তার গাড়িচালক। আগুনে শারমিনের মতো সুরমা বেগমও এক কাপড়ে জীবন নিয়ে বের হয়ে গেছেন। কোনো আসবাবপত্র রক্ষা হয়নি। এখন খোলা আকাশের নিচে সন্তানসহ অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটছে। তিনি জানান, এবারই প্রথম নয় ২০১৭ সালেও একবার আগুন লেগে তিনি সবকিছু হারিয়েছেন। এভাবে বারবার আগুন লাগে আর তারা পথে বসেন সবকিছু হারিয়েছে। আগুন লেগে নিঃস্ব হন আবার নতুনভাবে যখন ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন দেখা আবারো আগুন লাগে এভাবে আগুন লাগা এবং নতুনভাবে সংসার সাজাতে লড়াই করেই তারা বস্তিতে আছেন।

স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় আগুন লাগে বৌবাজার অংশ থেকে। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত। বস্তিতে যারা থাকেন প্রত্যেকের বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে। মূলত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন দ্রুত বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি আগুন নিভাতে স্থানীয়রাও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। আগুন রাত সাড়ে ১০টায় নিয়ন্ত্রণে এলেও গতকালও বিভিন্ন অংশে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আলী আহমেদ খান বলেন, এলপিজি গ্যাস যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে। বস্তির ঘরগুলো খুব ঘিঞ্জি, একটার সাথে আরেকটা লাগানো। ঘরগুলো কাঠ ও টিন আর কাগজের বক্স দিয়ে বানানো- যা দাহ্যবস্তু। ইলেকট্রনিক লাইনগুলো অনেক নিম্নমানের। রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডারগুলোতে আগুন লাগলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, বস্তিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য আগুন লাগাতে পারে। সেটার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। রাজনৈতিক কারণেও আগুন লাগানো হতে পারে। গোয়েন্দারা ভালো বলতে পারবেন।

আগুন নেভাতে দেরির কারণ ও সমাধানে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসে নতুন কোনো সদস্য কড়াইলের বস্তিতে গেলে সে রাস্তা খুঁজে পায় না। এ জন্য অভিজ্ঞ এবং যারা কড়াইল বস্তি সম্পর্কে জানে শুধু তারাই দ্রুত আগুন নেভাতে পারবে। কারণ কড়াইল বস্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা রয়েছে। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন আলাদা একটি ইউনিট ছিল কড়াইলের জন্য। সেখানে সাব স্টেশন করা, ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন ও অভিজ্ঞ জনবলকে মোতায়েন করার পরামর্শ দেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, কড়াইল বস্তিতে গেলে দেখবেন যে ওখানে যত্রতত্র বিদ্যুতের লাইন, যার অধিকাংশই অবৈধ। বাড়িঘরগুলোও একটার পাশে আরেকটা লাগানো, ঘিঞ্জি এমনভাবে লাগানো যে, ছোটখাটো আগুনও বড় হতে বেগ পায় না। মানে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়ে যায়।