ইরানের রাষ্ট্র সমালোচক ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহি ২২ বছরের বাধা অতিক্রম করে ফিরলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবে। দীর্ঘ রাজনৈতিক নিপীড়ন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে উৎসব থেকে দূরে থাকা এই পরিচালক এবার জিতে নিলেন কান উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বর্ণপাম (পাম দ’র)। তার নতুন রাজনৈতিক থ্রিলারধর্মী চলচ্চিত্র ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ (এটা ছিল কেবল একটি দুর্ঘটনা) তাকে এনে দিলো এই গৌরব।
পুরস্কার হাতে নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পানাহির কণ্ঠে শোনা গেল রাজনৈতিক আবেদন। তিনি বলেন, ‘আমি আজ শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নয়, একজন ইরানি হিসেবে কথা বলছি। আমাদের নিজেদের ভেতরের সব মতবিরোধ, দলাদলি এখন থামানো দরকার। আমাদের দেশের স্বাধীনতা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’
চলচ্চিত্রে প্রতিবাদের ভাষা : চলচ্চিত্র ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’-এ তুলে ধরা হয়েছে একদল প্রাক্তন বন্দীর গল্প, যারা ইরানের জেলে রাজনৈতিক কারণে আটক ছিল। গল্পে দেখা যায়, তারা হঠাৎ মুখোমুখি হয় সেই ব্যক্তির, যিনি তাদের বন্দিদশায় নির্যাতন করেছিলেন। তারা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে- প্রতিশোধ নেবে, নাকি ছেড়ে দেবে?
চলচ্চিত্রটি পরিচালকের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত। ইরান সরকারের সমালোচনার কারণে পানাহি একাধিকবার কারাগারে ছিলেন। ২০১০ সালে তাকে ২০ বছরের চলচ্চিত্র নির্মাণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, যদিও তিনি তা লঙ্ঘন করে গোপনে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং তা আন্তর্জাতিক উৎসবে পাঠিয়ে দেন। একবার একটি ইউএসবি চিপ একটি কেকের ভেতরে লুকিয়ে পাঠানো হয়েছিল বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে।
ইউরোপের ত্রয়ী জয় করলেন পানাহি : এই পুরস্কারের মাধ্যমে জাফর পানাহি এক অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করলেন। তিনি এখন ইউরোপের তিনটি বৃহত্তম চলচ্চিত্র উৎসব- ভেনিস, বার্লিন এবং কান-এর সর্বোচ্চ পুরস্কারজয়ী। ২০০০ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য সার্কেল’ (বৃত্ত) দিয়ে গোল্ডেন লায়ন (স্বর্ণ সিংহ), ২০১৫ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ট্যাক্সি’ দিয়ে গোল্ডেন বিয়ার (স্বর্ণ ভালুক), ২০২৫ সালে কান উৎসবে ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ দিয়ে স্বর্ণপাম (পাম দ’র)।এই অর্জন তাকে ইউরোপীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি বিশেষ আসনে বসিয়েছে।
রাজনীতি ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ছায়ায় উৎসব : চলতি বছর কান উৎসব নানা কারণে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে। সমাপনী দিনের সকালেই একটি বড় ধরনের দুধ্যুৎ বিভ্রাট (পাওয়ার আউটেজ) ঘটে, যার ফলে উৎসবস্থলসহ ফরাসি রিভিয়েরার বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়, ট্রাফিক সিগন্যাল নিষ্ক্রিয় হয়ে সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তবে আয়োজকেরা দ্রুত বিকল্প জেনারেটরের ব্যবস্থা করে প্রদর্শন ফের শুরু করেন। পালাই দে ফেস্টিভাল-এর (উৎসব ভবন) হলগুলো আবার সক্রিয় হয় এবং রাতে জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
উৎসবে রাজনীতি, প্রতিবাদ ও সাহসিকতা : এই বছরের কান উৎসব শুধু চলচ্চিত্র নয়, বরং রাজনীতি, প্রতিবাদ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে বারবার মুখ খুলেছে। উৎসবের উদ্বোধন হয় ফিলিস্তিনি ফটোসাংবাদিক ফাতমা হাসোনাকে উৎসর্গ করা একটি তথ্যচিত্র দিয়ে, ‘পুট ইওর সোল অন ইয়োর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক’ (তোমার আত্মা হাতে নিয়ে হাঁটো)। ফাতমা গত মাসে গাজায় একটি ইসরাইলি বোমা হামলায় নিহত হন।
এছাড়া উদ্বোধনী রাতে কিংবদন্তি মার্কিন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো তার আজীবন সম্মাননা গ্রহণের সময় আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে বলেন, চলচ্চিত্র ব্যবসাকে ধ্বংস করার জন্য ট্রাম্পের নীতিমালা একেবারে ‘বর্ণহীন’ ও ‘অসাংস্কৃতিক’।
নারী ও যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে কড়া বার্তা : চলচ্চিত্র অঙ্গনে #মি-টু আন্দোলনের প্রতিধ্বনি এবারের উৎসবে ছিল স্পষ্ট। ফরাসি অভিনেতা জেরার দেপারদিয়ু সম্প্রতি একাধিক নারীকে যৌন হেনস্তা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। একই দিনে কান কর্তৃপক্ষ একজন অভিযুক্ত অভিনেতাকে প্রিমিয়ার থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
রেড কার্পেটের পোশাক নিয়ে ‘নগ্নতা নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করা হলে বিতর্ক তৈরি হলেও, উৎসবের ভিতরে প্রথমবারের মতো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়।
অন্য পুরস্কারপ্রাপ্তরা
গ্র্যান্ড প্রি (দ্বিতীয় সেরা) : সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু- পরিচালনায় জোয়াকিম ট্রিয়ার; অভিনয়ে রেনাতে রিন্সভে ও এল ফ্যানিং, সেরা পরিচালক : ক্লেবার মেনডোসা ফিলহো-দ্য সিক্রেট এজেন্ট, ১৯৭০-এর দশকের ব্রাজিলের সামরিক শাসনে এক অধ্যাপকের পলাতক জীবনের গল্প, সেরা অভিনেতা : ওয়াগনার মৌরা (দ্য সিক্রেট এজেন্ট), সেরা অভিনেত্রী : নাদিয়া মেল্লিতি (দ্য লিটল সিস্টার)-এক কিশোরী ফরাসি-আলজেরীয় মেয়ের পরিচয় সঙ্কট ও যৌন পরিচয় সন্ধানের গল্প, সেরা চিত্রনাট্য : দারদেন ভ্রাতৃদ্বয়ের ইয়াং মাদারস-একটি কিশোরী মায়েদের আশ্রয়কেন্দ্রের মানবিক গল্প, প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কার (কামেরা দ’অর) : দ্য প্রেসিডেন্টস কেক-ইরাকি নির্মাতা হাসান হাদির প্রথম ছবি; সাদ্দাম হোসেনের আমলে জীবনের ছবি।
পানাহির শেষ বার্তা : ‘চলচ্চিত্র আমার অস্ত্র’ নিজের ক্যারিয়ারে নানা নিষেধাজ্ঞা, কারাবরণ, গৃহবন্দিত্ব সহ্য করে, জাফর পানাহি বারবার দেখিয়েছেন-শিল্প কখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট নিতে পারে, আমাকে জেলে পাঠাতে পারে। কিন্তু আমার ভাবনা কে আটকাবে? আমার চলচ্চিত্রই আমার অস্ত্র।’ জাফর পানাহির এই বিজয় শুধু একটি চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি নয়, বরং এটি শিল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক অবস্থান জানানোর একটি সাহসী নজির। কানের মঞ্চ থেকে তার কণ্ঠে উঠে আসা স্বাধীনতার ডাক প্রমাণ করে চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং এটি হতে পারে একটি জাতির আশা ও প্রতিবাদের দর্পণ।



