ডিজিটাল যুগেও নেটওয়ার্কের বাইরে ৪০ গ্রামের মানুষ

রিজার্ভ ফরেস্টের জায়গায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করা এসব জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্স ও বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনসহ সকল নাগরিক সুবিধা পাওয়া গেলেও নেই শুধু মোবাইল নেটওয়ার্ক। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ এখনো মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে।

এম মাঈন উদ্দিন, মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
Printed Edition

  • মিরসরাই ও ফটিকছড়ির ৪০ গ্রামের ৭০ হাজার গ্রাহক ভুক্তভোগী

  • পরিদর্শনে বন ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম

ডিজিটাল যুগেও এনালগে পড়ে রয়েছে ৪০ গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার গ্রাহক। দীর্ঘ সাত বছর ধরে নেটওয়ার্কবিহীন রয়েছে ওই গ্রামগুলো। রিজার্ভ ফরেস্টের জায়গায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করা এসব জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্স ও বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনসহ সকল নাগরিক সুবিধা পাওয়া গেলেও নেই শুধু মোবাইল নেটওয়ার্ক। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফটিকছড়ি উপজেলার প্রায় এক লাখ মানুষ এখনো মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে।

জানা গেছে, মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবি একটি টাওয়ার নির্মাণ করলেও তেল, যন্ত্রাংশ চুরি ও চাঁদাবাজির কারণে সাত বছর আগে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৪০ গ্রামের ৭০ হাজার গ্রাহক মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বঞ্চিত।

২০১৪ সালে মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পশ্চিম সোনাই গ্রামের মোল্লার বাগান টিলায় একটি টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল কোম্পানি রবি। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় ২০১৮ সালে টাওয়ারটি বন্ধ ও অচল হয়ে যায়। চুরি হয়ে যায় টাওয়ারের মূল্যবান যন্ত্রাংশ। সে থেকে টাওয়ারটি আর সচল করা হয়নি। অথচ ওই টাওয়ারের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে প্রায় ৪০টি গ্রামের মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা পেত। গ্রামগুলোর মধ্যে নয়টিলা, নলখো, সাইবেনিখিল, ত্রিপুরা পাড়া, বদ্দ ভবানী, ইসলামপুর, নয়দলং, পানুয়া, কুচিয়া খোন্দা, কালাপানি, বদিয়াপাথর, ভাঙা টাওয়ার, কয়লা, ইসলামাবাদ, রহমতপুর, গলাচিপা, পশ্চিম সোনাই, ঝিলতলী, মোহাম্মদপুর, বুলছড়ি, তালতলা, ঘরকাটা, গুইজাপাড়া, সোনার আগা, কালাকুম, সুবলছড়ি এবং ফটিকছড়ি উপজেলার বালুটিলা, কাজীপাড়া, পূর্ব ঝিলতলী, বান্দরমারা, বৈদ্দ্যেরথলী, পূর্ব সোনাই উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও স্থানীয় ৩০টি মসজিদ, ৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি এবতেদায়ি মাদরাসা ও ৬টি হাটবাজার নেটওয়ার্ক সুবিধা পেয়েছিল।

সম্প্রতি ‘সংযুক্ত হোক যোগাযোগ, জেগে উঠুক অধিকার, নেটওয়ার্ক সুবিধা আমাদের আইনসঙ্গত অধিকার’-এই স্লোগানে ৭০ হাজার গ্রাহকের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম একমাত্র রবি মোবাইল টাওয়ারটি চালুর দাবিতে গণস্বাক্ষর, আলোচনা ও পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাই কয়লা শহীদ জাকির হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচি আয়োজকদের একজন কামরুল হাসান নয়ন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিম সোনাই এলাকায় মোবাইল অপারেটর রবি কোম্পানির একটি টাওয়ার চালু ছিল। আমরা স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষিকাজ, আর্থিক লেনদেন ও পারিবারিক যোগাযোগ চালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে আমরা বিশাল যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বসবাস করছি। বর্তমানে রবি টাওয়ার স্থাপন করে পুনরায় নেটওয়ার্ক সুবিধা প্রদানের জন্য প্রস্তুত থাকলেও বন বিভাগের আপত্তির কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।

অন্য দিকে গত ২৫ মে বন ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক টিম এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছে বলে জানিয়েছেন মোবাইল অপারেটর রবির টেরিটরি কর্মকর্তা শাহাদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, গত ২০ থেকে ২৫ মে বিটিআরসিসহ আমাদের বেশ কিছু টিম করেরহাট ও ফটিকছড়ির ভুজপুর এলাকা পরিদর্শন করে। বন বিভাগের সাথে আমাদের আলাপ আলোচনা চলছে। শিগগিরই একটি সমাধান পাওয়া যাবে।

২০২৪ সালে সোমালিয়া জলদস্যুদের হাতে আটক হওয়া জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ফায়ারম্যান কয়লা এলাকার বাসিন্দা মোশারফ হোসেন শাকিল বলেন, জলদস্যুরা আমাদের আটকের পরপর মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। সপ্তাহে একবার সবাইকে পরিবারের সাথে কথা বলতে ৫ থেকে ৭ মিনিট সময় দিত। সবাই পরিবারের সাথে কথা বলতে পারলেও দেশের বাড়িতে নেটওয়ার্ক না থাকায় আমি কথা বলতে পারতাম না। তখন নিজের কাছে খুব খারাপ লাগত। বাড়িতেও আমাকে নিয়ে টেনশন করত। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, এ যুগে এসে আমাদের এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই, ভাবতে অবাক লাগে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ করেরহাট রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মো: হারুন অর রশিদ বলেন, বন বিভাগের জায়গায় কিছু নির্মাণ করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বন ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টিম এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছে। উভয় মন্ত্রণালয় বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।

এ বিষয়ে মিরসরাইয়ের ইউএনও সোমাইয়া আক্তার বলেন, উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে রবি টাওয়ার সংক্রান্ত বিষয়টি আমরা অবগত রয়েছি। স্থানীয় লোকজন আমাদের স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি টিম পরিদর্শন করেছে। এখানে টাওয়ার স্থাপনে যা যা করা প্রয়োজন উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।