নূরজাহান নীরা
পূর্ণ বয়স্ক নর ও নারীর জন্য রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে। রোজা যেমন মুসলমানদের জন্য ফরজ তেমনি এই রোজার ফজিলতও অনেক। রোজা যেমন মানুষকে পাপমুক্ত করে, তেমনি এই রোজা মানুষের শরীরকে অনেক সহায়তাও করে। রোজা বা সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষের অনেক বিষয়ে শিক্ষা অর্জনও হয়। দীর্ঘ সময় উপস থাকার মাধ্যমে যেমন আল্লাহর হুকুম পালন করা হয় তেমনি অনাহারি মানুষের ক্ষুধার জ্বালা অনুভবের শিক্ষাও এই রোজার মাধ্যমে সম্ভব। রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সূরা বাকারা : ১৮৩) অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে। (সূরা বাকারা : ১৮৫)
আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী রোজা পালন করলে মানুষ পাপমুক্ত হতে পারেন। একই সাথে অনেক রোগ থেকে মুক্ত হতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, রোজা পালনের সময় দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকা হয় আর এই দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে শরীরের জমে থাকা ক্ষতিকর চর্বি ভাঙতে থাকে এবং ওজন কমাতে ও ফ্যাটিলিভার কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া দীর্ঘ সময় উপস থাকায় পরিপাক ক্রিয়ায় অংশ নেয়া অঙ্গগুলো বিশ্রামের সুযোগ পায়। রোজার উপকারিতা সম্পর্কে স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী তার ‘সুপিরিয়র নিউট্রিশন’ গ্রন্থে ডা: শেলটন বলেছেন, উপবাসকালে শরীরের মধ্যকার প্রোটিন, চর্বি, শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি বিধান হয়। নোবেল বিজয়ী ওষুধ ও শল্যচিকিৎসার প্রখ্যাত ডা: অ্যালেকসিস বলেছেন, উপবাসের মাধ্যমে লিভারে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়।
অভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হৃদপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে।
এই চর্বি ক্ষয় হওয়ার কারণে উচ্চরক্তচাপ কমে যায়, কমে যায় ডায়াবেটিস। রক্তের চর্বি কমাতে হার্টের অনেক রোগ থেকে মুক্তি লাভ হয়। রোজা রাখার ফলে ৩০-৪০ শতাংশ উপকারী কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায় এবং শরীরে সজীবতা ফিরে আসে। রাসূল সা: বারবার বলেছেন, রোজা রাখো সুস্থ থাকো। রাসূল সা: রমজান মাসের বাইরেও রোজা রাখতেন এবং সবাইকে রোজা রাখতে উৎসাহিত করতেন।
যেমন সাওয়ালের রোজা, মহররমের রোজা, আরাফাতের দিনে রোজা, সপ্তাহে দু’দিন সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা, প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩-১৫ তিন দিন বা আইয়ামেবিজের রোজা, কোনো কোনো অপরাধের কাফফারা হিসেবে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এখন মাঝে মধ্যে উপবাস নিয়ে পাশ্চাত্যে যে আলোড়ন হচ্ছে বা স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা যে গবেষণা করছেন সে বিষয়ে অনেক আগেই রাসূল সা: আমাদের উৎসাহিত করেছেন। এমনকি খাবার গ্রহণের ব্যাপারেও রাসূল সা: পেটের তিন ভাগের এক ভাগ খাবার দিয়ে পূর্ণ করার জন্য বলেছেন। এখন অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চিকিৎসার অংশ হিসেবে খাবার কম খেতে বলেন এবং মাঝে মধ্যে রোজা বা উপস থাকার পরামর্শ দেন। এই উপস থাকার ফলে শরীরের অনেক ক্ষতিকর জীবাণুর ধ্বংস হয়। এমনকি ক্যান্সারের মতো কঠিন জীবাণু ধ্বংসের কথা গবেষণায় উঠে এসেছে। রোজার উপকারিতা নিয়ে আরো বেশ ক’জন বিজ্ঞানী তাদের মতামত দিয়েছেন যেমন- ডা: আইজাক জেনিংস বলেছেন, ‘যারা আলস্য ও গোড়ামির কারণে এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনী শক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোজা তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করে।’
বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী নাষ্টবারনার বলেন, ‘ফুসফুসের কাশি, কঠিন কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা কয়েক দিনের রোজার কারণেই নিরাময় হয়।’
ডাক্তার দেওয়ান এ কে এম আব্দুর রহীম বলেছেন, রোজাব্রত পালনের কারণে মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্র সর্বাধিক উজ্জীবিত হয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডা: আব্রাহাম জে হেনরি রোজা সম্পর্কে বলেছেন, ‘রোজা হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়।’ ডাক্তারদের মতে, রোজার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ার কারণে মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়-যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। বহুমূত্র রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোজা খুব উপকারী। ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেছে, একাধারে ১৫ দিন রোজা রাখলে বহুমূত্র রোগের অত্যন্ত উপকার হয়। কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখলে এ সমস্যা আরো বেড়ে যাবে ভেবে রোজা রাখতে চান না। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজা রাখলে কিডনিতে সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন দূরীভূত হয়। আরো গবেষণায় দেখা গেছে, রোজাদার পেপটিক আলসারের রোগীরা রোজা রাখলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্যও রোজা উপকারী। সার্বিক পর্যালাচোনায় বোঝা যায়, রোজা পালন যেমন সওয়াবের কাজ তেমনি রোজার আছে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা। আমরা সবাই চেষ্টা করব রোজার মাসের এ ফজিলত যেন আমাদের হাত ছাড়া না হয়। আল্লাহর আদেশ মেনে চলব। রোজা রাখব, সুস্থ থাকব।