যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক অদ্ভুত ফর্মুলা অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন। ট্রাম্পের নতুন এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল। এতে রফতানিকারকদের কপালে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। এমন পরিস্থিতিতে দেশের রফতানি, বিনিয়োগ ও অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সবদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে সে দেশে আরোপিত শুল্কের অর্ধেক হারে শুল্ক আরোপ করেছেন। তবে শুল্কের এই হিসাব করা হয়েছে অদ্ভুত এক ফর্মুলায়। তবে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক পর্যালোচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক পুনর্বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেছেন, বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দ্রুত শুল্ক যুক্তিসঙ্গত করার বিকল্পগুলো চিহ্নিত করছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা আছে।
শুল্ক নির্ধারণের ফর্মুলা : ট্রাম্প প্রশাসন বিদ্যমান বাণিজ্য ভারসাম্যের ভিত্তিতেই পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করেছে। একই সাথে এসব দেশের শুল্ক হারের সাথে সামঞ্জস্য আনার অঙ্গীকার করেছে। দেশগুলোর অন্যান্য আমদানি বাধার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
বুধবার রাতে দেয়া এক বিবৃতিতে শুল্ক নির্ধারণের পদ্ধতি জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই পদ্ধতিতে কোনো দেশের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্তকে ভাগ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির মোট রফতানিকে দিয়ে। আর এসব সংখ্যা নেয়া হয়েছে মার্কিন পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৪ সালের তথ্য থেকে। পরে এসব সংখ্যাকেই দুই দিয়ে ভাগ করে ‘ছাড়কৃত’ শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়।
যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত গত বছর ছিল ২৯৫ বিলিয়ন ডলার। মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ৪৩৮ বিলিয়ন ডলার। এই ক্ষেত্রে উদ্বৃত্তের অনুপাত দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশ। ট্রাম্প প্রশাসনের ফর্মুলায় এই উদ্বৃত্তকে ২ দিয়ে ভাগ করলে শুল্কের হার দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশ। সে পরিমাণ শুল্ক চীনের ওপর আরোপ করা হয়েছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও এই হিসাব তাদের ওপর আরোপিত শুল্কহারের কাছাকাছি ফলাফল দিয়েছে। তবে যেসব দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে তারাও সার্বিক ১০ শতাংশ শুল্কের আওতায় এসেছে। যেসব দেশের সাথে আমদানি ও রফতানি প্রায় সমান তারাও ছাড় পায়নি ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতর (ইউএসটিআর) তাদের বিবৃতিতে আরো বলেছে, প্রকৃত বাণিজ্য বাধাগুলোর হার এভাবে হিসাব করা সম্ভব হলেও হিসাবের এই পদ্ধতি ট্রাম্পের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিটি দেশের হাজারো রকমের শুল্ক, নিয়ন্ত্রক বিধিমালা, কর ও অন্যান্য নীতির মিলিত প্রভাবে যে বাণিজ্য ঘাটতি, তা স্বতন্ত্রভাবে হিসাব করে বের করা বেশ জটিল, হয়তো অসম্ভবও। এ জন্য এসবের মিলিত প্রভাবের প্রক্সি হিসেবে তাদের শুল্কের মাত্রাকে হিসাবে অন্তুর্ভুক্ত করা হয় যাতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি শূন্যে নামিয়ে আনা যায়।
বুধবার হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে ট্রাম্প বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর শুল্ক ঘোষণা করেন। এ ক্ষেত্রে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বিভিন্ন দেশের আরোপিত শুল্কের’ অর্ধেক হারকে ‘ছাড়কৃত পাল্টা শুল্ক হার’ হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার আগ পর্যন্ত কিভাবে শুল্ক নির্ধারিত হতে চলেছে সেই পদ্ধতি তেমন কেউই জানতেন না। তা ছাড়া ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে শুল্কের যে বিবরণী ছিল তার থেকেও ঘোষিত শুল্কের হারগুলোর সামান্য হেরফের রয়েছে। যেমন- ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের সাথে যুক্ত তালিকায় দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৬ শতাংশ শুল্কারোপের কথা বলা হলেও ঘোষণা করা হয়েছে ২৫ শতাংশ। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মার্কিন পণ্য রফতানিতে করসহ শুল্ক ও অশুল্ক সব ধরনের বাধার ভিত্তিতে পাল্টা শুল্ক হার হিসাব করা হয়েছে। শুল্ক ঘোষণার সময় ট্রাম্প শুল্ক হার নির্দেশ করা একটি বোর্ড হাতে নিয়ে দেখান। সেখানে ‘মুদ্রার দরে কারসাজি ও বাণিজ্য বাধার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরোপিত শুল্কসমূহ’ লেখা ক্যাটাগরির ছকে শুল্ক হারগুলো তুলে ধরা হয়।
এতেই স্পষ্ট হয়েছে, হোয়াইট হাউজ প্রথমে যেভাবে বলেছিল বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর সেভাবে শুল্কের হার হিসাব করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্কারোপ : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ হলো ভারতের পণ্যে ৫২ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ২৬ শতাংশ, চীন পণ্যে ৬৭ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ৩৪ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ৩৯ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ২০ শতাংশ, ভিয়েতনামের পণ্যে ৯০ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ৪৬ শতাংশ, তাইওয়ানের ৬৪ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ৩২ শতাংশ, জাপানের ৪৬ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ৫০ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ৭২ শতাংশের বিপরীতে ৩৬ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডের ৬১ শতাংশের বিপরীতে ৩১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬৪ শতাংশের বিপরীতে ৩২ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৪৭ শতাংশের বিপরীতে ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় ৯৭ শতাংশের বিপরীতে ৪৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ৬০ শতাংশের বিপরীতে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্র ইসরাইলের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক হিসাবের বিপরীতে আরোপ করেছে ১৭ শতাংশ শুল্ক। অপর দিকে শ্রীলঙ্কার ৮৮ শতাংশের বিপরীতে ৪৪ শতাংশ, পাকিস্তানের ৫৮ শতাংশের বিপরীতে ২৯ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৩৪ শতাংশের বিপরীতে ১৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে যেসব দেশের ১০ শতাংশ শুল্ক হিসাব করা হয় ওইসব দেশের ওপরও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন দেশের তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুর, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, কলম্বিয়া।
উদ্বেগ অর্থনীতিবিদ ও রফতানিকারকদের মধ্যে : দেশের রফতানিকারকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর ফলে রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে তৈরী পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পোশাক খাতে বাংলাদেশের যারা প্রতিযোগী দেশ ভারতের ওপর যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। পোশাকের পরবর্তী অর্ডারগুলো অল্প সময়ের জন্য ভারতে চলে যাবে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে রফতানিকারকেরা।
দেশের রফতানিকারকেরা বলছেন চীন থেকে বড় বিনিয়োগের আশা করেছিলেন তারা। এখন দেখা যাচ্ছে আমেরিকার বাজারে চীনের শুল্কহার কম বাংলাদেশের তুলনায়। এ কারণে চীন থেকে বড় বিনিয়োগ নাও আসতে পারে। এতদিন বলা হয়েছে, মেড ইন বাংলাদেশ হলে আমেরিকার বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে যে বিনিয়োগ বাংলাদেশে হয়েছে, সেগুলো হয়তো বাংলাদেশে আর নাও থাকতে পারে। বাণিজ্য, রফতানি ও বিনিয়োগ তিন খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে রফতানি বাণিজ্যের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা।
দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় কাঠামোগত বাণিজ্যিক চুক্তি বা টিকফা আছে। এর মাধ্যমে সরকার আলাপ-আলোচনা শুরু করতে পারে। এবার শুল্ক বসিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, মার্কিন বাণিজ্য দফতর থেকে সিদ্ধান্তটি হয়নি। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে দুটো জায়গায় কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। তাদের সরাসরি যোগাযোগ করতে হবে। পাশাপাশি এনবিআরকে কিছু জিনিস রিভিউ করতে হবে। আমেরিকায় রফতানি ক্ষেত্রে কত শতাংশ শুল্ক আছে। ওই করগুলো কিভাবে কমানো যায়, তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এনবিআরকে ট্যারিফ কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, বাড়তি শুল্কহারের কথা শুনে অনেকেই আতঙ্কিত হতে পারে। বিশেষ করে পোশাক ব্যবসায়ী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। তারা উদ্বেগের মধ্যে পড়ে যাবে, শুল্ক তারতম্যের কারণে অন্য দেশে হয়তো আরো বেশি সুযোগ অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে হন্ডুরাস, মিসর ও তুরস্ক। এই দেশগুলোর ওপর ওইভাবে বড় শুল্ক নেই। এটা তাদের জন্য বড় সুবিধা। বিনিয়োগকারীরা ওই সব দেশে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এত বেশি শুল্ক আরোপ করলে বড় সমস্যা হবে। তৈরী পোশাক রফতানি ও অন্য পণ্য রফতানি কমে গেলে সেটা হবে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। এমনিতেই দেশের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তার মধ্যে এ ঘটনা ঘটল। আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা মনে করেন।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান নয়া দিগন্তকে বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব দেখেছে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাল্টা (রেসিপ্রোকাল) শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন, যা দীর্ঘ দিন ধরে জিএটিটি বা ডব্লিউ কাঠামোর মূল স্তম্ভ হিসেবে থাকা ‘সর্বাধিক অনুকূল দেশ’ এমএফএন নীতির সমাপ্তি বা অন্তত উল্লেখযোগ্য রূপান্তরের সঙ্কেত বহন করছে। এই নীতির ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার। কারণ বিভিন্ন মার্কিন বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর ভিন্ন ভিন্ন পারস্পরিক শুল্ক হার আরোপিত হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট পণ্যের ক্যাটাগরির ওপর শুল্কের হারও পরিবর্তিত হচ্ছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বিজয়ী ও পরাজিত দেশ নির্ধারণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ আরো অস্থির ও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে, কারণ তারা এমন এক অনিশ্চিত ব্যবস্থায় কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে, বাংলাদেশকে তার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে, বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং মূল বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে হবে, যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় তার অবস্থান নিরাপদ থাকে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল নয়া দিগন্তকে বলেন আমেরিকা যে ট্যারিফ আরোপ করেছে আসলে এটি হচ্ছে রিসিপ্রকাল। অর্থাৎ আমরা আমেরিকার পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে ট্যারিফ আদায় করে থাকি তার অর্ধেক আরোপ করা হয়েছে আমাদের পণ্যের ওপর। আমেরিকা নতুন করে যে শুল্কহার করেছে তা অবশ্যই দেশের বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শুধু তাই নয় প্রায় ৬৯টি দেশের প্রতি ট্যারিফ আরোপ করা হয়েছে তা সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শুভকর নয় বলে তিনি মনে করেন
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন নয়া দিগন্তকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। নতুন এ শুল্ক নীতি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপরে যেসব কারণে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে, সেগুলো দূর করে এ শুল্ক কমিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারলে নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই প্রভাব পড়বে আমেরিকার অর্থনীতিতে চাহিদা কমার কারণে। ধারণা করা হচ্ছে এই ট্যারিফ (শুল্ক) আরোপ করায় আমেরিকার অর্থনীতিতে মন্দা আসবে। সবকিছুর দাম বাড়বে। এতে ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমতে পারে। ফলে বাংলাদেশ থেকে রফতানি কমার আশঙ্কা রয়েছে।’
তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান খুব বেশি পরিবর্তন হবে না বলে জানান তিনি। কারণ অন্যান্য দেশের ওপরও যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে, এমনকি কিছু দেশের ক্ষেত্রে তা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি। ফলে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকাসহ অন্য দেশগুলোও একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে, কোনো বাড়তি সুবিধা পাবে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ হাতেম নয়া দিগন্তকে বলেন বাংলাদেশের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে আগে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো। বর্তমানে আবার ৩৭ শতাংশ নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। বর্তমানে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সাড়ে ৫২ শতাংশ শুল্ক পরিষদ করতে হবে। এতে দেশের পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তিনি মনে করেন।
আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ইস্যুর ইতিবাচক সমাধান হবে : প্রধান উপদেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ইস্যু সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে দূঢ় আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। যেহেতু এটি আলোচনাযোগ্য, তাই আমরা আলোচনা করব এবং আমি নিশ্চিত যে আমরা সর্বোত্তম সমাধানে পৌঁছাতে পারব।’
গতকাল ব্যাংককে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অধ্যাপক ইউনূসের বরাত দিয়ে বাসসকে এসব কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্য আমদানির ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, এখনো পুরো বিষয়টি আলোচনা শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। আমরা এটা পর্যালোচনা করছি এবং আমরা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছি, তাতে আশাবাদী সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে। আমরা এমন একটা সমাধানের দিকে যেতে পারব, যাতে উভয় পক্ষের জন্য উইন উইন সিচুয়েশন হয়।
প্রেস সচিব দৃঢ় আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, আমরা এমন কিছু করব যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে বলে জানান তিনি।
এর আগে গতকাল সকালে শফিকুল আলম বাংলাদেশী পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার বাড়ানোর বিষয়ে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লিখেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক পর্যালোচনা করছে। এসব শুল্ক আরও যুক্তিসঙ্গত করার উপায় খুঁজে বের করতে দ্রুত ও কার্যকরভাবে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), যা শুল্কবিষয়ক জটিলতা নিরসনে প্রয়োজন।
প্রেস সচিব আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমাদের বৃহত্তম রফতানি গন্তব্য। ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একসাথে কাজ করে আসছি।
শফিকুল আলম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের চলমান কার্যক্রম শুল্ক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
সমালোচনার ঝড় : এ দিকে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বিভিন্ন দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। কিছু দেশের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কল্পনাতীত শুল্ক আরোপ করেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। যেখানে এতদিন পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যালেক্স ট্রাভেলি।
যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বিভিন্ন দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের পর বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। কেননা কিছু দেশের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কল্পনাতীত শুল্ক আরোপ করেছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। যেখানে এতদিন পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ করে শুল্ক ছিল। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের অর্থনীতি বিষয়ক সংবাদদাতা অ্যালেক্স ট্রাভেলি।
সংবাদ মাধ্যমটির লাইভ আপডেটে অ্যালেক্স লিখেছেন, ট্রাম্পের আজকের পদক্ষেপের ফলে সবচেয়ে বেশি এবং বেদনাদায়কভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দশম স্থানে থাকা দেশটি গত আগস্টে রাজনৈতিক উত্তেজনার পর থেকে সঙ্কটে রয়েছে। তিনি বলেন, দেশটির কারাখানগুলোর প্রচুর পোশাক তৈরি করে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোট পোশাকের প্রায় এক পঞ্চমাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে বলে সতর্ক করেছেন অ্যালেক্স ট্রাভেলি। তিনি আরও বলেছেন, নতুন করে আরোপ করা ৩৭ শতাংশ শুল্ক বিদ্যমান ১৫ শতাংশের সাথে যোগ করা হোক বা না হোক, আমেরিকায় ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যকে অনেক ব্যয়বহুল এবং বিরল করে তুলবে।
উল্লেখ্য, অ্যালেক্স ট্রাভেলি নয়া দিল্লিতে অবস্থিত দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের বাণিজ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদদাতা। ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন এই সাংবাদিক। এ ছাড়া দ্য ইকোনমিস্টের সম্পাদক এবং সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
বড় রফতানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র : বাংলাদেশের প্রধান দুই রফতানি বাজারের একটি যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরী পোশাকের একটি বড় অংশ রফতানি হয় দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে বাংলাদেশের রফতানি হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন (৮৪০ কোটি) ডলার, যা প্রধানত তৈরি পোশাক। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী পোশাক রফতানি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন (৭৩৪ কোটি) ডলার।