রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ট্রাম্পের একটি ফোন কলই যথেষ্ট

সাক্ষাৎকার : ব্রিগে: জেনারেল (অব:) শামীম কামাল

“শুধু কূটনৈতিক আলোচনায় এ সঙ্কট নিরসন হবে না। মিয়ানমারের সাথে আমাদের আস্থার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কেবল আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আস্থায় এনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া।”

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
ব্রিগে: জেনারেল (অব:) শামীম কামাল
ব্রিগে: জেনারেল (অব:) শামীম কামাল

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শামীম কামাল বলেছেন রোহিঙ্গা সঙ্কট সামরিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ সমস্যা সমাধানে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক ছাড়াও বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্ভাগ্য নিম্নমানের পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসন করা যায়নি। তিনি বলেন, শুধু কূটনৈতিক আলোচনায় এ সঙ্কট নিরসন হবে না। মিয়ানমারের সাথে আমাদের আস্থার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কেবল আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আস্থায় এনে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া। একই সাথে তিনি বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে নেয়ার পর প্রস্তাব আকারে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করলেও চীন এর বিরুদ্ধে ভেটো দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

নিরাপত্তা ও সামরিক বিশ্লেষক শামীম কামাল বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপেই মিয়ানমার আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জান্তা প্রধান জেনারেল মিন হংলাকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ফোন কলই যথেষ্ট। এ জন্য বাংলাদেশকে আরো প্রোঅ্যাকটিভ হতে হবে।

নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শামীম কামাল এসব কথা বলেন।

নয়া দিগন্ত : মিয়ানমার কিভাবে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে এ ধরনের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে?

শামীম কামাল : যুদ্ধ কৌশলের ছাত্র হিসেবে বলছি রোহিঙ্গা সঙ্কট সামরিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আগেও বলেছি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের এয়ার প্যারিটি যদি ৩০ঃ১ না হতো তাহলে তারা রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে ঢুকিয়ে দেয়ার সাহস পেত না। বিপজ্জনক আকাশ প্রতিরক্ষা থাকায় এটি সম্ভব হয়েছে। তারা বারবার আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। রোহিঙ্গাদেরকে আমাদের আট হাজার একর জায়গা দিতে হয়েছে। এটি তো দখলই। আমাদের ফোর্সসিবলি মিয়ানমারে একটা জায়গা দখল করে সেখানে রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করতে হতো। এটিই সামরিক ব্যবস্থা বা সমাধান। এটি সামরিকভাবেই করতে হয়। আমরা তো আগাগোড়াই শুনে আসছি আমরা শান্তি চাই তবে আক্রান্ত হলে... এগুলো হচ্ছে প্রহসন। পুরো জাতিকে ধোঁকার মধ্যে রেখে এসব কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ওয়েস্ট ফেলিয়ান ট্রিটি অনুসারে সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আমাদের ভূখণ্ডে ঠেলে দেয়ার মাধ্যমে আমাদের সার্বভৌমত্ব চরমভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। প্রতি বছর ২০-২৫ বার আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে মিয়ানমার। প্রতিবেশী দেশগুলো চিন্তা করে তারা যা ঘটাতে যাচ্ছে, তা মোকাবেলা করার সামর্থ্য আমাদের আছে কি না। যেকোনো বাধা প্রতিরোধ ও আক্রমণ করার মতো শক্তি বা ডেটোরেন্স আমাদের থাকতে হবে। পটেনশিয়াল মানে আমার শত্রুকে পাল্টা আঘাত করলে সে যেন তা ভালোভাবে উপলব্ধি করে। দ্বিতীয়ত, ক্রেডিবল অর্থাৎ এই পাল্টা আঘাতের জন্য সে ব্যথায় ছটফট করবে। তৃতীয়ত, কমিনিকেট করতে হবে এবং এই জায়গায় আমাদের সামর্থ্য একেবারে শূন্য। উত্তর কোরিয়া কয়েক দিন পরপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে দেখায় যে আক্রান্ত হলে সে কী করতে পারে। মিয়ানমার তখনই ভয় পেত যে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ঢুকিয়ে দিলে বাংলাদেশ এয়ারফোর্স নেইপিদোতে এসে আঘাত হানতে পারে। ১৯৯০ সালে রেজুপাড়া বিওপি মিয়ানমার ফোর্স এসে দখলের পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গেলে আমরা কিছুই করতে পারিনি। এরপর নায়েক মিজানকে মেরে ফেলল। অব্যাহতভাবে এসব করে গেলেও আমরা কেবল ডিপ্লোমেটিক প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। কন্টিউনিয়াসলি এরকম একটা ধারণা তারা পেয়েছে বাংলাদেশ কিছুই করতে পারবে না।

নয়া দিগন্ত : আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনের উপায় কী?

শামীম কামাল : বিষয়টি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে যেতে হবে। এরপর তা প্রস্তাব আকারে নিয়ে যেতে হবে নিরাপত্তা পরিষদে। শঙ্কা হচ্ছে চীন এতে ভেটো দেবে। কারণ চীন কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না। স্বার্থের ক্ষেত্রে চীন ব্যালান্সশিট নিয়ে চিন্তা করে বলেই মিয়ানমারের জান্তা ও বিদ্রোহী উভয়কে সে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য চীন সুন্দর কথা বললেও একটি রোহিঙ্গা যাতে ফেরত যেতে না পারে সেটি নিশ্চিত করবে। চীনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রেয়ার আর্থ মেটাল; সে ধরনের খনিজে মিয়ানমারের অবস্থান বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে। অস্ত্র ও ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনে এ খনিজ চীনের খুব প্রয়োজন। রাখাইনসহ এসব প্রদেশে আরাকান, শান, কাচিন বিভিন্ন বিদ্রোহীদের ট্যাক্স দিয়ে চীন এসব খনিজ সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া সিতুইতে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন তেল সরবরাহ ধরে রেখেছে, যা মালাক্কা প্রণালী দিয়ে আমদানি করলে কয়েকগুণ বেশি খরচ হতো।

নয়া দিগন্ত : তাহলে উপায়?

শামীম কামাল : আশার কথা যে এ অঞ্চলে মার্কিনিদের নজর পড়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একটা সিম্পল কল যথেষ্ট। পুরো বিশ্বব্যবস্থা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করে যেটা পারবে না; মিয়ানমারের জান্তাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাপ সৃষ্টি করলে সেটা হয়ে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আগামী ডিসেম্বর মিয়ানমারে নির্বাচনের পেছনে মার্কিন চাপ রয়েছে। জেনারেল মিন হংলা খুশি যে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের বার্মা অ্যাক্ট দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আউট অব দ্য সিন হলেও তাদের নজর এখনো রয়েছে। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমার সফর করার পর ৫০ বছরের মধ্যে দেশটিতে নির্বাচন হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের মন গলাতে হবে, তাকে আস্থায় আনতে হবে। ট্যারিফের বিষয়টি বাংলাদেশ চমৎকারভাবে হ্যান্ডেল করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশকে আরো প্রোঅ্যাকটিভ হতে হবে। অত্যন্ত প্রভাবশালী দেশ চীনকে নিউট্রালাইজড করার জন্য একমাত্র দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

নয়া দিগন্ত : প্রতিরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগে অবহেলা কি প্রতিবেশী দেশসহ বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের সাথে ভূকৌশলগত দরকষাকষিতে পিছিয়ে রাখছে কি না?

শামীম কামাল : তা তো রাখছেই। অবশ্যই এমনটি হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। প্রতিরক্ষা যদি দুর্বল হয়ে থাকে তাহলে সেই দেশগুলোর ওপর জুলুম, অত্যাচার, অন্যায্য আচরণ হবেই। এটিই স্বাভাবিক।

নয়া দিগন্ত : এখান থেকে ওভারকাম করার উপায় কী, আমাদের তো জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি নেই?

শামীম কামাল : ডেটোরেন্স বা নিবারক শক্তি বাড়াতে হবে। সে জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

নয়া দিগন্ত : প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সবসময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে, তার পরও বিগত কয়েক দশকে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি... এখন কিভাবে সম্ভব হবে?

শামীম কামাল : প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের এ সম্পর্কে ধারণা খুবই দুর্বল ও নিম্নমানের ছিল। দলীয় স্বার্থকেন্দ্রিক ছিল। জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারটা একেবারেই ভীষণভাবে অবহেলিত হয়ে আছে।

নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার, সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে কিন্তু কার্যত প্রত্যাবাসনের কোনো আলামত দেখছি না, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টি নিয়ে অনেক ধরনা দিয়েছে...

শামীম কামাল : এটিকে বলা হচ্ছে ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ট্র্যাক ডিপ্লোমেসি। যেখানে সরকার, এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রচেষ্টার সাথে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মিশ্রণ ঘটিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার মতো জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যায় আস্থা এবং সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এ ধরনের অফিসিয়াল কূটনীতির বৈধতার সাথে অনানুষ্ঠানিক কূটনীতির নমনীয়তা ও সৃজনশীলতাকে একত্রিত করে, যা আলোচনা এবং সমাধানের জন্য আরো ব্যাপক পদ্ধতির সুযোগ করে দেয়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোনোভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এনগেজ করতে পারতাম তাহলে একটা ভালো সমাধান আসতে পারত।

নয়া দিগন্ত : কিন্তু ভারত থেকে তো মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছে বাংলাদেশ আরাকানে করিডোর দিয়ে দিচ্ছে ইত্যাদি, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি রুখে দেয়ার কারণেই এ ধরনের অপপ্রচার চলে...

শামীম কামাল : দ্বিপাক্ষিক একটি বিষয় তো আছেই। বড় ধরনের নেগেটিভ বিষয় তো আছেই। করিডোরের বিষয়ে দেশেও রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা করেছে। করিডোর হোক বা রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে তৃতীয় শক্তি বা যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িত করতে পারলে একটি ভালো ফলাফল আসতে পারত।

নয়া দিগন্ত : কিন্তু রাখাইনে কালাদান প্রজেক্টে ভারত ৩ বিলিয়ন ডলার এবং সিতুইয়েতে চীন ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আর বাংলাদেশে কেবল রোহিঙ্গা জনস্রোতের প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে...

শামীম কামাল : এখানে অনেকভাবে কাজ করা যায়। রাখাইনে এখন সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হচ্ছে আরাকান আর্মি। আরাকান আর্মিকে আমরা সমর্থন করলে পুরো পরিস্থিতি উল্টে যেতে পারত।

নয়া দিগন্ত : জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফরের সময় আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের ওপর তাগিদ দিয়ে গেছেন।

শামীম কামাল : জাতিসঙ্ঘ এখানে খুব একটা রোল প্লে করতে পারবে না। এখানে প্রভাবক শক্তি হলো প্রথম চীন এবং দ্বিতীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ দু’টি দেশ চাইলে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসন সম্ভব। কিন্তু চীন কোনো দিনই চাইবে না আমাদের এখান থেকে রোহিঙ্গা রিপ্যাট্রিয়েশন শুরু হোক। যদি যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চায় এবং বাংলাদেশ তা ফ্যাসিলেটেড করে তাহলে আমাদের জন্য একটি বড় ধরনের উপকার আসতে পারে। আর এখানে মিয়ানমারের সাথে তো আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। টোটালি কাটঅফ। এ জন্য এখানে ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ট্র্যাক ডিপ্লোমেসি দরকার ছিল। আরাকান একসময় স্বাধীন হবেই। সে ক্ষেত্রে আরাকানের সবচেয়ে নিকটতম বিশ্বস্ত প্রতিবেশী হতে পারে বাংলাদেশ। যদি আরাকান আর্মি রাজি হয় যে কোনো শর্তে যে, ঠিক আছে তোমরা আমাদের সমর্থন দাও, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবো, তবেই শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে।

নয়া দিগন্ত : দিন কয়েক আগে বেইজিংয়ে সামরিক কুচকাওয়াজে মিয়ানমারের জান্তা প্রধান জেনারেল মিন হংলাকে দেখা গেল। মিয়ানমারে গণতন্ত্র নেই বা রোহিঙ্গা সঙ্কট ছাড়াও বিভিন্ন জাতিগত নিধন চলছে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাহলে কোনো আন্তর্জাতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা কাজ করছে না? বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে চীন তাহলে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আন্তরিক নয় কি?

শামীম কামাল : এ পরিস্থিতিতে চীন মনে করছে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক তো ভালোই আছে। জেনারেল মিন হংলাকে চীন কেন, যুক্তরাষ্ট্র কিছু দিন আগে ৪০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করেছে মিয়ানমারের ওপর। মিন হংলাতো তাতে খুশি। এটি নির্ভর করে ডেটোরেন্সের ওপর। চীন দেখাতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যদি এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় তাহলে ভারত ও রাশিয়াকে নিয়ে সে কাউন্টার মুভ করবে। এটিই হচ্ছে ডেটোরেন্স।

নয়া দিগন্ত : কিন্তু শেখ হাসিনা তো শেখ রেহানার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, যদি উনি ১৮ কোটিকে খাওয়াতে পারেন তাহলে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়াতে পারব না কেনো...

শামীম কামাল : ওটা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর ছাড়া কিছু নয়। ওসব দিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটের কোনো সমাধান হয়নি, হবেও না। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, কারণ ১৯৮০ সালে মিয়ানমারের সিটিজেন অ্যাক্টে তাদের দেশটির নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। অথচ ১৯৬৪ সাল থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক ছিল, রোহিঙ্গা মন্ত্রীও ছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করা হয়েছে রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে। তার পর থেকে বছরে তাদের পেছনে ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে দাতা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে। এখন সেই সহায়তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একদম আগামী নভেম্বর মাস থেকে।

নয়া দিগন্ত : রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন তাহলে কিভাবে সম্ভব? অব্যাহতভাবে রোহিঙ্গারা আসছে। তাদের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে।

শামীম কামাল : আমাদের বসে থাকা ঠিক হবে না। পদ্ধতিগতভাবে সমাধানে আগাতে হবে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন দিনের যে সম্মেলন করলেন সেখানে শতাধিক সংস্থা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এ মাসের শেষে নিউ ইয়র্কে আরেকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট অত্যন্ত ভুলভাবে হ্যান্ডেল করা হয়েছে। তুরস্কে দেখেন সিরিয়ার শরণার্থীদের ১৭টি প্রদেশে ভাগ করে দিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে। আমরা রোহিঙ্গাদের অথর্ব করে বসিয়ে রেখেছি, বংশবৃদ্ধি ছাড়া তারা কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ করছে না। নিম্নমানের পরিকল্পনার কারণে এটি হয়েছে। গার্মেন্টস বা টেক্সটাইলে তাদের কাজে লাগানো যেত। শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। এরা স্টেটলেস হলেও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যেকোনো রাষ্ট্র বাধ্য। কক্সবাজারে বা ভাসানচরে গার্মেন্টস কারখানা সম্প্রসারণ করে উৎপাদিত পোশাক ‘রোহিঙ্গা ব্র্যান্ড’ হিসেবে বিশ্বে রফতানির উদ্যোগ নেয়া গেলে এইচএন্ডএম, প্লেবয়, গ্যাপ, মার্কসএন্ডস্পেন্সার’-এর মতো রোহিঙ্গা একটা ব্র্যান্ড হলে ওআইসিসহ অনেক দেশ ধর্মীয় সেন্টিমেটের কারণে বা রিপ্রাইজেলের কারণে হোক পণ্যগুলো নিত।

রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করা উচিত ছিল ওয়ার্কার হিসেবে। ইনডাইরেক্ট অ্যাপ্রোচে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সেনসেটাইজ করতে পারলে তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে যাওয়ার আকাক্সক্ষা আরো তীব্র হতো। অধ্যাপক ইউনূসের রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনের সাত দফার প্রথমটি হচ্ছে তাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক দিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন করে রোহিঙ্গাদের দক্ষ করার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড যে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা, তারা সচেতন হতো। তারা তাদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন ফোরামে যেত। পাঁচজন স্মার্ট শিক্ষিত রোহিঙ্গা তরুণ তরুণী জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের প্রত্যাবাসনের দাবি জানাতে পারত। জেনেভাসহ বিভিন্ন স্থানে তারা তাদের দাবিকে তীব্র করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারত। শুধু বিদেশী সহায়তার ওপর নির্ভর করে রোহিঙ্গাদের বসিয়ে রাখা ঠিক হয়নি। দক্ষ করে তুলতে পারলে অনেক দেশ তাদের কর্মী হিসেবে নিত। তারা এখন বার্ডেন। অলরেডি স্থানীয়দের মার্জিনালাইজ করে ফেলেছে। সন্তান উৎপাদন ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। গাছপালা কেটে পরিবেশ বিনষ্টের পাশাপাশি এভাবে তারা গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেছে। ড্রাগ, অস্ত্র চোরাচালানে তারা জড়িয়ে পড়ছে। সমতলে আমাদের সমাজে তারা মিশে যাচ্ছে। এসব ক্ষতিকারক বিষয় আমরা প্রটেক্ট করতে পারছি না।