শীতে বাড়ে স্ট্রোক

শীতে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি যেমন বাড়ে তেমন বাড়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি। দুটোকে একসাথে বলার কারণ হলো দুটো কিন্তু একই রোগ না। হার্ট অ্যাটাক হলো হার্টের রোগ আর স্ট্রোক হলো ব্রেন বা মস্তিষ্কের রোগ। হার্ট অ্যাটাক হলে বুকে মারাত্মক ব্যথা বা চাপ দিয়ে ধরা, বমি, ঘাম হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না করালে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। স্ট্রোক হলে শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়, মুখ একদিকে বেঁকে যায়, কথা জড়িয়ে যায়। অনেক সময় চোখে দেখার সমস্যা, শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পারার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু
Printed Edition

শীতকাল আসে নবান্নের উৎসব নিয়ে। যদিও এখনকার বেশির ভাগ মানুষ জানে না নবান্ন কী? তবে এখনকার মানুষ শীতে ঘুরে বেড়াতে বেশ পছন্দ করেন। এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না যারা শীতকালে কোথাও ঘুরতে যান না। শীতের এ সুখকর সময়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে বন্দী থাকা মানুষের পরিমাণও কিন্তু কম নয়। শীতে বাড়ে শ্বাসকাশির সমস্যা। ত্বকের সমস্যার তো শেষ নাই। তবে মারাত্মক কিছু রোগ কিন্তু বেড়ে যায় শীতের সময়টাতে।

শীতে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি যেমন বাড়ে তেমন বাড়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি। দুটোকে একসাথে বলার কারণ হলো দুটো কিন্তু একই রোগ না। হার্ট অ্যাটাক হলো হার্টের রোগ আর স্ট্রোক হলো ব্রেন বা মস্তিষ্কের রোগ। হার্ট অ্যাটাক হলে বুকে মারাত্মক ব্যথা বা চাপ দিয়ে ধরা, বমি, ঘাম হতে পারে। দ্রুত চিকিৎসা না করালে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

স্ট্রোক হলে শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়, মুখ একদিকে বেঁকে যায়, কথা জড়িয়ে যায়। অনেক সময় চোখে দেখার সমস্যা, শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পারার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

স্ট্রোক হয় মস্তিষ্কের রক্তনালী ব্লক হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে। অথবা রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে। সে হিসেবে স্ট্রোক দুই ধরনের- ১. ইস্কেমিক স্ট্রোক ২. হেমোরেজিক স্ট্রোক। স্ট্রোক বেশ ভয়াবহ রোগ। সারা বিশ্বে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ স্ট্রোক।

আসলেই কি শীতে স্ট্রোক বাড়ে?

শীতে স্ট্রোক বাড়ে এটা কি ভয় দেখানোর জন্য না, আসলেই বাড়ে? গবেষণা কী বলে? আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সেমিনারে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে শীতে স্ট্রোকের হার বাড়ে। তারা বলেছেন, তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি কমার জন্য স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার বাড়ে ৬ শতাংশ।

ইস্কেমিক স্ট্রোকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক লাখ ৭২ হাজার রোগীর মধ্যে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে দেখা গেছে, শীতের দিনে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। এ তথ্য ২০১৬ সালে জার্নাল অব স্ট্রোক অ্যান্ড সেরেব্রোভাস্কুলার ডিজিজে প্রকাশিত হয়েছে।

জার্মানিতে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ১১ শতাংশ বাড়ে। আর যাদের স্ট্রোকের অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর আছে তাদের এ হার আরো বেশি। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব এপিডেমিওলজিতে ২০১৬ সালে এ গবেষণা প্রকাশিত হয়।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাপমাত্রা কমার কারণে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার বেশি, বিশেষ করে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৬৫ হাজার ব্যক্তির ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে।

শীতে কেন বাড়ে স্ট্রোক

আমরা সবাই জানি উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। তাপমাত্রা কমার কারণে শরীরে নরএড্রেনালিন নিঃসরণ হয়। এটি রক্তনালীকে সঙ্কুচিত করে। এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তচাপের কারণে রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

তাপমাত্রা কমার কারণে রক্তের মধ্যে প্লাটিলেট নামক যে কণিকা থাকে তা জমাট বাঁধার আশঙ্কা বাড়ে। রক্ত জমাট বাঁধলে রক্তনালী ব্লক হয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় স্ট্রোক।

হিউমিডিটি বা আর্দ্রতার কারণে বাড়ে স্ট্রোক। শীতকালে আর্দ্রতা বেশি থাকে।

শীতকালে শারীরিক পরিশ্রম বেশ কম হয়। এতে করে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অনেকে শীতের মধ্যে অ্যালকোহল বেশি পান করেন। তাদের ঝুঁঁকি বেড়ে যায়। শীতকালে মানসিক অবসাদ বাড়ে। একাকী লাগে বেশি। মনের ওপর এ চাপে হতে পারে স্ট্রোক।

ঝুঁকি কমাতে করণীয়

স্ট্রোকে একবার আক্রান্ত হলে বারবার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাই স্ট্রোক থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। শীতকালে নিয়ন্ত্রণে রাখুন উচ্চ রক্তচাপ। নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করুন। অনিয়ন্ত্রিত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ডায়াবেটিস ও স্ট্রোক একই মায়ের সন্তান। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করুন কঠোরভাবে। ধূমপান ও মদপানে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। শীতে ধূমপান একেবারেই বন্ধ করুন।

হার্ট অ্যাটাক, অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, হার্ট বড় হয়ে যাওয়া, ভাল্বের সমস্যা ইত্যাদি কারণে রক্তজমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। তাই এ রোগগুলোর চিকিৎসা করান।

পুষ্টিকর খাবার খান : প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খান। প্রতিদিনের খাবারে পাঁচ ভাগের একভাগ ফলমূল ও শাকসবজি খান। রেড মিট যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়ার গোশত কম খান। চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করুন। এতে বেশি স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যেটি ধমনীতে চর্বির আস্তরণ পড়তে সহায়তা করে। লবণ রক্তচাপ বাড়ায়। লবণ খাবেন না। আঁশযুক্ত খাবার বেশি বেশি করে খান।

কমিয়ে ফেলুন শরীরের অতিরিক্ত ওজন

নিয়মিত ব্যায়াম করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যায়াম করে তাদের রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। হাঁটা ভালো ব্যায়াম। হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় মেনে হাঁটুন। সপ্তাহে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ মাইল হাঁটুন।

মানসিক চাপ কমান : রাগ কমান, কমিয়ে ফেলুন মানসিক চাপ। জোর করে হলেও হাসুন প্রাণ খুলে। মেডিটেশন করতে পারেন। এতে কমবে মানসিক চাপ, বাড়বে আত্মবিশ্বাস।

রক্তে কোলেস্টেরল কমিয়ে ফেলুন : রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হলে চর্বি জমে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায়। নিয়ন্ত্রণে রাখুন কোলেস্টেরলের মাত্রা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস, ঢাকা