পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জুনাইদ আহমেদ পলক। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন নাটোরের যুবকবয়সী মন্ত্রী। সেই ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে চোখের পলকে অগাধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন পলক। তার দুর্নীতির অন্যতম উৎস ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি, এ-টু-আই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইটেক পার্ক, আইটি পার্ক প্রভৃতি। অভিযোগ রয়েছে, এসব খাতে ১০ পার্সেন্ট থেকে ১৫ পার্সেন্ট পর্যন্ত কমিশন দিতে হতো পলক সিন্ডিকেটকে। কাজ পেতে লাইসেন্স ব্যবহার করার শর্তও জুড়ে দেয়া হতো টেন্ডার দাখিলকৃত ঠিকাদারি কোম্পানিকে। বনিবনা না হলে পছন্দমতো কোম্পানিকে টেন্ডার পাইয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা পলক হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অংশগ্রহণকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দাবি অনুযায়ী, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সক্ষম ও নিম্ন দরদাতা কোম্পানিগুলোকে উপেক্ষা করে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০২১ সালে ঢাকা, বরিশাল ও রাজশাহী অঞ্চলে অপটিক্যাল ফাইবার অপ্টিমাইজেশন প্রকল্পে প্রায় ১০৫ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। সেখানে আটটি কোম্পানি অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নেশনটেক কমিউনিকেশন লিমিটেড দাবি করছে, অভিজ্ঞতা, ন্যূনতম দর এবং টেকনিক্যাল সক্ষমতায় তারা অধিকতর যোগ্য হলেও কাজ পায়নি। এ প্রসঙ্গে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম শিমুল জানান,“আমাদের প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন বড় প্রকল্প যেমন বিটিসিএল, রেলওয়ে, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের অধীনে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার অপ্টিমাইজেশনের অভিজ্ঞতা রাখে। তবুও আমাদের বাদ দিয়ে বেশি দর দাখিল করা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়, যাদের ন্যূনতম টার্নওভার, স্পেসিফিক এক্সপেরিয়েন্স-সহ অন্যান্য শর্তও পূরণ ছিল না।”
সূত্র বলছে, ওই সময় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের পিএস নাজমুল হক বকুল নেশনটেক কমিউনিকেশন লিমিটেডের শ্যামলী রিং রোডের অফিসে গিয়ে একাধিকবার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে মিটিং করেন। কোম্পানিকে কাজ পাওয়ার জন্য ফিফটিন পার্সেন্ট কমিশনও অফার করা হয়। তা ছাড়া তিনটি প্রজেক্টের মধ্যে একটির কাজ পলক তার তত্ত্বাবধানে করার জন্য নেশনটেকের লাইসেন্স ব্যবহার করবে এমন শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। এসব শর্তে রাজি না হওয়ায় কাজ পায় সিএসএল-এসএলই জেবিসি, নিঝুম এন্টারপ্রাইজ-সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান যারা অধিকতর দরদাতাও ছিল।
এ প্রসঙ্গে নেশনটেক কমিউনিকেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তিনটি কাজের জন্যই আমার কোম্পানি অধিকতর যোগ্য ছিল। প্রতিমন্ত্রী আমাকে একবার উনার অফিসে ডেকে কফি খাওয়ান এবং উনার পিএস বকুলকে যুক্ত করে দেন এই প্রজেক্টের বিষয়ে যেকোনো আলাপ-আলোচনার জন্য। অফিসে বসেই প্রতিমন্ত্রী উনার পিএস বকুলের সাথে সমন্বয় করে নিতে বলেন। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই পলকের পিএস বকুল অফিসে এসে কমিশনবাবদ নগদ পাঁচ কোটি টাকা চান। ওই টাকা দিতে সম্মত না হওয়ায় আমাকে কাজ না দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। পরবর্তীতে অন্য একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয় যে কোম্পানিটির মিনিমাম টার্নওভার ছিল না। চার হাজার কিলোমিটার অপ্টিক্যাল ফাইবার অপ্টিমাইজেশনের অভিজ্ঞতা থাকা এবং বিডিং প্রাইস কম থাকার পরেও কাজ না দেয়ায় কোম্পানির এমডি ইফতেখারুল ইসলাম শিমুল সিপিটিইউ বরাবর আপিল করেন পাঁচটি লটের কাজের বিপরীতে। শুনানির দিন ধার্যের ঠিক আগের দিন প্রতিমন্ত্রী নেশনটেকের অফিসে উনার প্রতিনিধি পাঠান এবং উনার সাথে ফোনে কথা বলেন নিজেই। উনি পরামর্শ দেন, যেহেতু এটা খুবই প্রায়োরিটি প্রজেক্ট তাই কিছুটা শিথিলভাবে শুনানিতে অংশ নেয়ার কথা বলে দেন। এতে নেশনটেক ভীত হয়ে একটি লটের শুনানিতে ক্যাজুয়ালি অংশ নেয় এবং বাকি চারটি লটে শুনানিতে অংশগ্রহণই করেন নাই। একপর্যায়ে প্রতিমন্ত্রীর প্রজেক্টে সিপিটিউ বরাবর রিভিউ করার জন্য নেশনটেককে পরবর্তী এক বছরের জন্য ব্ল্যাক লিস্টেড করে দেয়া হয় আইসিটি মন্ত্রণালয়ে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের নজিরবিহীন পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অনুষ্ঠিত এক পর্যালোচনা সভায় উঠে আসে, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এর মধ্যে দুই অর্থবছরে (২০১৯-২০ ও ২০২০-২১) বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার টাকার অনিয়ম পায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষা বিভাগ। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করার পর অর্থনীতির যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়, তাতেও সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয় আইসিটি খাত। অভিযোগ উঠেছে, পরিবারের সদস্যসহ অনুগত কর্মীদের নামে-বেনামে পলক সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। পলকের ‘ফাইভ স্টার’ বাহিনীর সদস্যরাও হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কণিকা পেশায় স্কুলশিক্ষিকা হলেও অবৈধভাবে গত ১৫ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
জুনাইদ আহমেদ পলক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে এ খাতে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, নিয়োগ বাণিজ্য আর বিশেষ বরাদ্দ টি-আর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের নামে অর্থ লুটপাট করার গুরুত্বর অভিযোগ ওঠে। ওই অর্থে নিজ এলাকা নাটোরের সিংড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে গড়ে তোলেন বিপুল সম্পত্তি। কিন্তু গত ১৫ বছরে আইসিটি খাতের কোনো কাজই তেমন আগায়নি। আগের কাজ সম্পন্ন না করেই আরেক টেন্ডার, এক সফটওয়্যার বানাতে তিন কোম্পানিকে কাজের সুযোগ দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ভুঁইফোড় ভেন্ডরের মাধ্যমেই লুটপাট হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। পলকসহ সংশ্লিষ্টদের ভয়াবহ এসব দুর্নীতি পিছিয়ে দিয়েছে ডিজিটালাইজশেন প্রক্রিয়াকে।
এ দিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের ২১টি প্রকল্পে হরিলুটের প্রমাণ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি। এসব প্রকল্পের কেনাকাটা থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণ- প্রতিটি প্রকল্পের দুর্নীতির নকশা প্রণয়ন করতেন পলক। তার নির্দেশনায় প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি, কনসালট্যান্ট ও ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে কেনাকাটা সবই করা হতো। পকেট ভর্তি করতে এক কাজ বারবার করা হয়েছে। আবার একই প্রকল্প দুই মন্ত্রণালয়ে গ্রহণ করেও সরকারের অর্থ অপচয় করা হয়েছে বলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ৬ আগস্ট হজরত শাহজালাল রহ: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে জুনায়েদ আহমদ পলককে আটক করা হয়। পরে তাকে ছাত্র হত্যাসহ কয়েকটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পলক কারাগারে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।