কলকাতায় ‘মিনি বাংলাদেশ’এ লোকসান ৫ হাজার কোটি রুপি

বাংলাদেশী মুদ্রার লেনদেনও এখন থমকে পড়েছে

ভারতীয় মিডিয়াটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘এক বছরে হাজার কোটি রুপি লোকসান, সুদিনের অপেক্ষায় কলকাতার ‘মিনি বাংলাদেশ’।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিট
কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিট |সংগৃহীত

হাসিনা সরকার পতনের পর ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশী পর্যটকদের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসায় সেখানকার ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়াটি প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে, ‘এক বছরে হাজার কোটি রুপি লোকসান, সুদিনের অপেক্ষায় কলকাতার ‘মিনি বাংলাদেশ’।

কলকাতার বিখ্যাত নিউ মার্কেটের কাছাকাছি, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ও মারক্যুইস স্ট্রিট ঘেঁষে অবস্থিত এ ‘মিনি বাংলাদেশ’ দীর্ঘ দিন ধরেই ছিল বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পর্যটকদের পছন্দের স্থান। এক বছর আগেও কলকাতার ‘মিনি বাংলাদেশ’ খ্যাত ছোট এই এলাকাটি ছিল খাদ্য, আতিথেয়তা ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু গত বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশি পর্যটকদের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসায় এলাকাটির ব্যবসায় ধস নেমেছে।

এক বছর পার হলেও এলাকাটি ওই অস্থিরতার ফল ভোগ করছে, ব্যবসায় ক্ষতি ছাড়িয়েছে হাজার কোটি রুপির বেশি, বলছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। এখানে সস্তায় হোটেল পাওয়া যায়, খাবারে মেলে ‘ওপার বাংলার’ পদ, কাছাকাছিই আছে রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, আছে একাধিক চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। এক বছর আগেও এই এলাকা এতটাই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল যে পর্যটকদের ভিড়ে পা ফেলার উপায় ছিল না। আর এখন, এক সময়ের জমজমাট গলিগুলো একেবারেই সুনসান।

একাধিক ব্যবসায়িক সংগঠনের দেয়া মোটাদাগের হিসেবেই এক বছরে ‘মিনি বাংলাদেশের’ লোকসান হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। তবে আসল ক্ষতি এর কয়েক গুণ বলে ধারণা অনেকের। “হোটেল, খাবারের দোকান, ট্র্যাভেল এজেন্ট, মুদ্রা লেনদেন, চিকিৎসাসেবা এবং পরিবহন ব্যবসা, সব মিলিয়ে দৈনিক প্রায় তিন কোটি রুপি লেনদেন হতো। ফ্রি স্কুল ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হায়দার আলি খান বলেন, আমরা যদি নিউ মার্কেট আর বড়বাজারের ক্ষতির হিসাব করি, তা-ও পাঁচ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে।

এখন পর্যটক না থাকায় একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয় দোকান গুটিয়ে নিয়েছে, নতুবা স্থানীয় ক্রেতা ধরায় মনোযোগী হয়েছে। মারক্যুইস স্ট্রিটের একটি ট্র্যাভেল কোম্পানির ব্যবস্থাপক প্রবীর বিশ্বাস বলেন, “এই এক বছর আগেও পর্যটকবাহী একাধিক বাস প্রায় একই সময়ে পৌঁছাত, যে কারণে পার্কিং-ই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। আর এখন, কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও একজন পর্যটকের দেখা পাওয়া যায় না।”

বাংলাদেশী মুদ্রার লেনদেনও এখন অনেকটাই থমকে পড়েছে।

মারক্যুইস স্ট্রিটের কারেন্সি এক্সচেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মোহাম্মদ ইন্তিজার বলেন, ‘টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। পুরোপুরি বাংলাদেশী পর্যটক নির্ভরশীল ছিলাম আমরা।” ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ‘মিনি বাংলাদেশ’ এলাকায় থাকা ছোট ও মাঝারি মানের প্রায় ৪০ শতাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে।

বড় বড় অনেক খাবারের দোকানকেও এখন টেনেটুনে চলতে হচ্ছে। রাঁধুনি রেস্তোরাঁর মালিক এনসি ভৌমিক বলেন, “ব্যবসা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, আমাদের অনেকের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা কোনো রকমে ঝুলে আছি, ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় আছি।” ঢাকায় ক্ষমতার রদবদলই এখানকার ব্যবসায়ীদের জন্য ‘একমাত্র ধাক্কা’ নয়, তার আগে কোভিড মহামারীর অভিঘাতও সামলাতে হয়েছে তাদের।

মারক্যুইস স্ট্রিটের খুবই জনপ্রিয় এক খাবারের দোকানের মালিকের ছোট ভাই বলেন, “মহামারীর পর বড়সড় উত্থানের আশায় আমরা অনেকেই ব্যাপক বিনিয়োগ করেছিলাম। আমরা এমনকি দোকান সংস্কার এবং ব্যবসা বড় করতে ঋণও নিয়েছি। এই টালমাটাল অবস্থার আগ পর্যন্ত ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল। আমার বড় ভাই চাপ নিতে না পেরে অসুস্থই হয়ে পড়েছেন। যৎসামান্য আয় হচ্ছে, অথচ প্রতি মাসে দেড় লাখ রুপি কিস্তি টানতে হচ্ছে।”

বড় বড় দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বাইরে, পর্যটকদের আনাগোনা ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনীতি, যেমন বাড়িতে রান্না করা খাবার সরবরাহ, বাড়ি ভাড়া, ট্যুর গাইড এসবও একপ্রকার লাটে উঠেছে।

হোটেলে কর্মী, রাঁধুনি, ড্রাইভার, খুচরা দোকানদার হিসেবে কাজ করা শত শত স্থানীয় বাসিন্দা হয়েছে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এলিয়ট রোডের বাসিন্দা ফারহান রসুল বলেন, “মহামারীর পর যখন চাহিদা বেড়ে গেল তখন আমি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারে দু’টি গাড়ি কিনি। ব্যবসা এত ভালো চলছিল যে অনেক সময় কাস্টমারদের ফিরিয়েও দিতে হতো। এখন আমি মাসে টেনেটুনে ৫-৬টার মতো বুকিং পাই, তা-ও স্থানীয়দের কাছ থেকে, যারা খুব বেশি খরচ করতে চায় না। এ দিকে আমাকে কিস্তি দিতে হচ্ছে।”