লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক শহর জেদ্দা সেজে উঠেছে চলচ্চিত্রের মহোৎসবে। রেড সি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চম সংস্করণ এবার ‘সিনেমার প্রেমে’ স্লোগান নিয়ে শুরু হয়েছে। এই উৎসবটি যেন এক বিশাল সমুদ্র, যেখানে বিশ্বজুড়ে সিনেমা, তারকা এবং নতুন প্রতিভা এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। ৪ ডিসেম্বর থেকে শরু হওয়া এই উৎসব চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই বছরের আসরটি দর্শকদের জন্য সিনেমা এবং তার পেছনের মানুষগুলোকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
রেড কার্পেটে তারার মেলা এবং নতুন আকর্ষণ
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ নিঃসন্দেহে দেশী-বিদেশী তারকার উপস্থিতি। এ বছর জুরি বোর্ডের সভাপতির আসনে রয়েছেন অস্কারজয়ী আমেরিকান পরিচালক শন বেকার, যিনি স্বাধীন চলচ্চিত্র জগতে তার সাহসী কাজের জন্য সুপরিচিত। তার সভাপতিত্বেই নির্বাচিত হবে সেরা চলচ্চিত্রগুলো। আরব ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মধ্যে রয়েছেন মিসরীয় সিনেমার কিংবদন্তি লাইলা এলউই, যিনি পঞ্চাশের দশক থেকে তার অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে আসছেন। এছাড়াও অস্কারজয়ী অভিনেতা অ্যাড্রিয়েন ব্রডি, ভারতীয় অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, ব্রিটিশ-আরব অভিনেতা আমির এল-মাসরি এবং সৌদি তারকা ইয়াকুব আল-ফারহান আলোচনা সেশনগুলোতে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবেন।
দর্শকদের জন্য এবার নতুন সংযোজন হলো ‘অডিয়েন্স জোন’। প্রথমবারের মতো চালু হওয়া এই উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষ রেড কার্পেটে তাদের প্রিয় তারকাদের সাথে সরাসরি দেখা করার সুযোগ পাচ্ছে, যা উৎসবটিকে আরো বেশি সামাজিক ও অংশগ্রহণমূলক করে তুলেছে।
বৈচিত্র্যময় চলচ্চিত্র ও মূল প্রতিযোগিতা
উৎসবের শৈল্পিক প্রোগ্রামটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। এর মূল আকর্ষণ হলো ফিচার ফিল্মের অফিশিয়াল প্রতিযোগিতা, যেখানে আরব বিশ্ব, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে মোট ১৬টি চলচ্চিত্র মর্যাদাপূর্ণ ‘ইওসর পুরস্কারে’র জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিকশন, ডকুমেন্টারি এবং অ্যানিমেশন- সব ধরনের শিল্পরূপ।
আলোচিত আরব ছবি : সৌদি পরিচালক শাহাদ আমিনের ‘হিজরা’ (যা অস্কারের জন্য সৌদি আরবের আনুষ্ঠানিক জমা), লেবাননের ‘স্টারস অব হোপ অ্যান্ড পেইন’ এবং ফিলিস্তিনি-আমেরিকান পরিচালক চেরিয়েন ডাবিসের ‘হোয়াটস লেফট অব ইউ’ এই বিভাগে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে।
নিউ সৌদি সিনেমা : সৌদি আরবের স্থানীয় চলচ্চিত্রের নতুন ধারা তুলে ধরতে এই বিভাগে মোহাম্মদ নূরের জীবন নিয়ে তৈরি ‘নূর’ এবং হজ নিয়ে নির্মিত আধ্যাত্মিক ডকুমেন্টারি ‘দ্য হিউম্যান টাইড’সহ পাঁচটি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে।
আরব মাস্টারপিস : সমসাময়িক আরব সিনেমার সেরা কাজগুলো এই বিভাগে প্রদর্শিত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে হাইফা আল-মানসুরের থ্রিলার ‘দ্য আননোন’ এবং লাইলা এলউই অভিনীত ডার্ক কমেডি ‘ম্যারেজ অর ফিউনারেল’।
ভবিষ্যতের প্ল্যাটফর্ম : তরুণ প্রতিভা ও বাজার
রেড সি উৎসব শুধু ছবি দেখায় না, নতুন প্রতিভা তৈরি এবং শিল্পের প্রসারেও কাজ করে।
ইমার্জিং ট্যালেন্টস : এই বিশেষ প্রোগ্রামটি ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী উঠতি নির্মাতাদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে পরিচালনা ও প্রযোজনা ব্যবস্থাপনার উপর কর্মশালাসহ প্রায় ১২টি চলচ্চিত্র এখানে তাদের কাজ পেশাদার প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে।
রেড সি মার্কেট : উৎসবের এই ‘স্পন্দনশীল হৃদয়’টি চলচ্চিত্র শিল্পের পেশাদারদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এটি অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ তৈরি করে। এ বছর ২৪টি নির্মাণাধীন প্রকল্পের পাশাপাশি আটটি সিরিজ প্রকল্পও এখানে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছে। বিশেষ সেমিনার : এই মার্কেট আলোচনা সভা, কর্মশালা ও প্যানেল আলোচনার আয়োজন করে, যেখানে শিল্প বিশেষজ্ঞরা প্রযোজনা, অর্থায়ন এবং সৃজনশীলতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন।
বহু সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা এবং কণ্ঠস্বরের এক মোজাইক এই রেড সি চলচ্চিত্র উৎসব। সিনেমা এবং তার শিল্পীদের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এই মিলনমেলা আরব অঞ্চলে এক প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করছে।



