সড়ক দুর্ঘটনা

নিহতের ৪১ শতাংশই মোটরসাইকেলে

২০২৪ সালে দুই হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই হাজার ৫৭০ জন নিহত ও তিন হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছেন।

আব্দুল কাইয়ুম
Printed Edition

প্রতিনিয়ত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সড়কে ঝরছে প্রাণ। এসব দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিকে দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুসারে, গত মার্চ মাসে সারা দেশে ২২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২৫১ জন নিহত ও ২০৮ জন আহত হয়েছেন। যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৪১ দশমিক শূন্য এক শতাংশ ও আহতের ১৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তা ছাড়া মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ২৭ শতাংশ ছিল মোটরসাইকেলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চার চাকার যানবাহনের চেয়ে এসব বাহন ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। মোটরসাইকেলের গতি যখন প্রতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হয় তখন প্রতি পাঁচ কিলোমিটার বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যায় বলেও জানান তারা। তবে চালক বা আরোহী মাথায় মানসম্পন্ন হেলমেট ব্যবহার করলে দুর্ঘটনায় ৪৮ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অধিকাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে পরিবারে বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ছাড়াও এসব দুর্ঘটনার ফলে একই সাথে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনাও কম নয়।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৭৫৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৭২৪ জন নিহত হয়েছেন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৪০ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ছিল ৪১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল ৭৭৮টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের ৭৫ দশমিক ২৩ শতাংশই হচ্ছে কিশোর ও তরুণ, যাদের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। তা ছাড়া দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ মোটরসাইকেলচালক এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া গত ২০২৪ সালে দুই হাজার ৭৬১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন দুই হাজার ৬০৯ জন। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মোটরযান রয়েছে তার ৭১ শতাংশ হচ্ছে মোটরসাইকেল।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০২৪ সালে দুই হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই হাজার ৫৭০ জন নিহত ও তিন হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, নিহতের ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ ও আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বিগত ১০ বছরে মোটরসাইকেল ১৫ লাখ থেকে ৬০ লাখে উন্নীত হওয়ায় সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলাচলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ভয়াবহভাবে বাড়ছে।

গতকাল প্রকাশিত যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চে সারা দেশের ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১২ জন নিহত, ১২৪৬ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে ১৪৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫০ জন নিহত ও ৩৬৪ জন আহত হয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় ৯১০টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এতে দেখা যায়, ২৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ ট্রাক-পিকাপ-কাভার্ডভ্যান ও লরি, ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ বাস, ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, পাঁচ দশমিক ১৬ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ১০ শতাংশ নছিমন-করিমন-মাহিন্দ্রা-ট্রাক্টর ও লেগুনা, পাঁচ দশমিক ৪৯ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার বদল হলেও পরিবহনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। মোটরসাইকেলের চালক ও ট্রাফিক আইনের অপব্যবহারসহ সড়কে বিভিন্ন বিষয়ের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। বেপরোয়া গতির কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও তরুণ। তাদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার প্রবণতা প্রবল। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে বাস এবং পণ্যবাহী ভারী যানবাহনের চাপায়। অনেক সময় বেপরোয়াভাবে চালানোর কারণে দক্ষ মোটরসাইকেল চালকরাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। মোটরসাইকেল চালকদের মানসম্পন্ন হেলমেট ব্যবহারের আগ্রহ কম। ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি।

এই বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো: হাদিউজ্জামান বলেন, মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা কম। তা ছাড়া এসব চালকরা বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো তারা রাস্তার ঝুঁকিকে কখনো ঝুঁকি মনে করে না। ফলে মহাসড়কে উঠলেই ট্রাফিক আইন না মেনে এগুলো গতির প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। তাদের বেপরোয়ার ফলে সড়কে অনেক বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তবে লেন পদ্ধতি না মেনে একই সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলার কারণে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের আরো বেশি দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। ধীরগতি, হালকা, ভারী ও ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লাইন থাকলে দুর্ঘটনা কমে আসত। বিআরটিএকে এ জায়গাগুলোতে আরো জোরালোভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।