ডেঙ্গু আতঙ্কে দেশবাসী, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। দেশে তিন বিভাগে আতঙ্কজনক হারে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি হলেও তা নিয়ন্ত্রণে সেই আগের মতোই গতানুগতিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে স্থানীয় সরকারেরে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলোর কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তারা মশা নিয়ন্ত্রণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করছে না। এভাবে বেড়ে যেতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে আগের বছরগুলোর মতো দেখা দিতে পারে ডেঙ্গুর মহামারী। যে হারে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে মশার প্রজনন স্থানগুলোতে মশা যেন না জন্মাতে পারে সেজন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শও দিয়েছেন কিটতত্ববিদরা। তারা বলছেন, একটা সময় বলা হতো ডেঙ্গু জীবাণু বহনকারী এডিস মশা শহুরে মশা কিন্তু এখন প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার পর আর তা শহুরে মশা বলার কোনো অবকাশ নেই। এটা শহর অথবা গ্রাম সর্বত্রই বেড়ে উঠতে পারে এবং মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনের ৩০ দিনে যত মানুষ সংক্রমিত হয়েছে ডেঙ্গুতে চলতি জুলাই মাসের গত ৮ দিনেই জুনের অর্ধেকেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। গত জুনে সারা দেশে ৫ হাজার ৯৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, কিন্তু চলতি জুলাইয়ের গত ৮ দিনেই ৩ হাজার ২৯৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুর দিক থেকে গত আট দিনে অর্ধেকেরও বেশি ছাড়িয়েছে জুলাইয়ে গত ৮ দিনে। জুনে সারা দেশে ১৯ জনের মৃত্যু হলেও চলতি জুলাইয়ের গত ৮ দিনে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, জুলাই মাসের ২০ দিনের মধ্যেই জুন মাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমনো হতে পারে জুলাই মাসে সারা বছরের সংক্রমণ ও মৃত্যুকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আগের বছরটা দেশ একটি ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনে থাকলেও এখানকার শাসনেও যদি ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে আর কখন মানুষ ডেঙ্গুহীন দিন যাপন করতে পারবে?
ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্যান্য বিভাগের চেয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে সবচেয়ে বেশি। এই তিন বিভাগের মধ্যে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। নিপসমের কিটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মো: গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা না হলে কিছু সময় হয়তো মশা থেকে দূরে থাকা যাবে কিন্তু স্থায়ী পরিবর্তন আসবে না।’ আবার হুট করে নতুন কোনো কিটনাশক ব্যবহার করার আগেও খুব ভালো ল্যাব টেস্ট করে নিতে হবে। আমাদের দেশে এই কাজটি করা হয় না। অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘বিদেশ থেকে যে কীটনাশকই আসুক তা প্রয়োগের আগে এর কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য অবশ্যই ল্যাবটেস্ট করে নিতে হবে। কারণ, বিদেশে যে কিটনাশক মশার জন্য তৈরি হয়ে থাকে তা ওদের দেশের পরিবেশের উপযোগী করে করা হয়। ফলে আমাদের দেশের পরিবেশে তা কাজ করবে কিনা, অথবা আমাদের দেশে প্রয়োগ করা হলে সেটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে কিনা সেটাও দেখে নিতে হবে।’
সারা দেশে গত জানুয়ারি থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫৯৪ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগেই জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ১২ হাজার ১০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অপর দিকে জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৫২ জনের মৃত্যু হলেও উল্লেখিত তিন বিভাগে ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। বরিশাল বিভাগে এ বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী দেখা গেলেও মৃত্যু দিক থেকে অবশ্য ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ছিল। এর কারণ হিসেবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা: এ কে এম সাজেদুর রহমান জানান, ‘ঢাকা বিভাগে বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোতে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগীরা এসে ভর্তি হয়। শেষ সময়ে তারা আসেন বলে তখন চিকিৎসকদের করার কিছু থাকে না। সেজন্য হয়তো ঢাকায় বেশি ডেঙ্গু রোগী মারা যায়। তবে তিনি বলেন, ‘এটা চিকিৎসক হিসেবে তার ধারণা, বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করলে আরো সূক্ষ্ম কারণ হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে।’
২০২৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, এডিস এজিপ্টাই ও এডিস এলবোপিক্টস এই দুই প্রজাতির ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার মধ্যে শহরে ৯৯ শতাংশই হলো এডিস এজিপ্টাই এবং মাত্র এক শতাংশ এডিস এলবোপিকটাস। কিন্তু গ্রামে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। ২০২৪ সালে নিপসম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় আইইডিসিআর কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলের ডেঙ্গু জীবাণুবাহী ৯৫ শতাংশ এডিস এলবোপিকটাস এবং ৫ শতাংশ এডিস এজিপ্টাই। এডিস এলবোপিকটাসকে বলা হয় জঙ্গলের মশা। এদের মূল প্রজনন স্থল হলো প্রাকৃতিক উৎস। কলা গাছের পাতার গোড়া, বাঁশের ফোকর, কচু গাছের ডগার মধ্যে জমে থাকা পানিতে এ ধরনের মশা পাওয়া গেছে। আর এডিস এজিপ্টাইরক ডোমেসটিক বা ঘরকুনো মশা বলা হয়। এরা কৃত্রিম পানির উৎস যেমন টায়ার, নারিকেলের খোলা, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের পাত্র, নির্মাণাধীন বাড়ির নিচের ফ্লোরের মতো স্থানে যেখানে পানি জমে থাকে সেখানে প্রজনন ঘটিয়ে থাকে। এ ধরনের মশার ঘনত্ব নির্ভর করে, শহরে বাড়ির ধরন, অবস্থান, পানি জমার পাত্রের উপস্থিতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতির ওপর। গ্রামে এডিস এলবোপিকটাসের ঘনত্ব নির্ভর করে বাড়ির আশপাশে অবস্থিত ঝোপঝাড়, পানি জমার পাত্রের উপস্থিতি এবং কৃত্রিম উৎস দু’টিতেই। শহর থেকে গ্রামে কেন এতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি হলো। ড. মো: গোলাম ছারোয়ার এ ব্যাপারে বলেন, শুধুমাত্র কীটনাশক দিয়ে এডিস মশা নির্মুল করা সব সময় সম্ভব নয়। কারণ কীটনাশক সর্বত্র পৌঁছানো যায় না। যারা কাজটি করেন তাদের যেমন অবহেলা থাকে আবার নীতি নির্ধারণের কিছু বিষয় থাকে। সেজন্য স্থানীয় মানুষকে এতে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পারলে, মশা নিয়ন্ত্রণে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তা হবে আরো বেশি কার্যকর। কারণ স্থানীয় মানুষ মশার প্রজনন স্থল খুবই ভালো করে অবগত।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা: মো: জহুরুল হক বলেন, বাংলাদেশে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। কারণ এই চার মাসে বৃষ্টির ধরনের কারণে পুরো দেশেই বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে এবং সেই স্থানগুলো এডিস মশা প্রজননে কাজে লাগায়। আবার এ সময়টা ডিম থেকে লার্ভা ফুটে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হওয়ার উপযুক্ত তাপমাত্রা থাকে। সে কারণে, এই জুলাই মাসেই মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।’
২৪ ঘণ্টার চিত্র : গত মঙ্গলবার সকাল ৮টার পর থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশে ৪০৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে। একই সময়ে সারা দেশে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৬ বছরের ওই রোগীর মৃত্যু হয়, তিনি কুমিল্লা দাউদকান্দী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে। গতকালও বরিশাল বিভাগে সর্বোচ্চ ৯৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছে, এর মধ্যে বরগুনা জেলায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৩ জন। এ ছাড়া গতকাল চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৮ জন, ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৬৪ জন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ৮৯ জন, খুলনা বিভাগে ৩৫ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪ জন, রংপুরে ৫ জন এবং সিলেট ২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।