বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ

পরিবেশ বিপর্যয়ে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের পথে ঢাকা

আবুল কালাম
Printed Edition

পরিবেশ বিপর্যয়ে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের পথে ঢাকা। দিন যত যাচ্ছে দূষণে ঢাকার অবনতি হচ্ছে। এ নিয়ে সভা সেমিনারে ক্ষোভ, সমালোচনা হচ্ছে। কখনো কখনো উদ্বেগের কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই যেন দূষণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। উল্টো বেপরোয়া দূষণ পরিবেশকে অসনীয় করে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা থাকলেও এ বিষয়ে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। ফলে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি মিলছে না। এরই মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।

গবেষণা বলছে, দিন যত যাচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয় তত বাড়ছে। তার প্রমাণ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের আট বছরের জানুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আর বছরের ফেব্রুয়ারি মাস দূষণের দিক থেকে ছিল শীর্ষে। যা বিগত আট বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৯ বছরে ঢাকায় নির্মল বাতাস ছিল মাত্র ৩১ দিন। বায়ুমান সূচকের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, গবেষণায় ইতোমধ্যে ঢাকার বাতাসে উচ্চমাত্রায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের অস্থিত্ব মিলেছে। এর মধ্যে রয়েছে- আর্সেনিক, সিসা ও ক্যাডমিয়ামের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান। এ ছাড়া গবেষণায় ঢাকা শহরের বাতাসে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এমন আরেকটি উপাদান কোবাল্টের উচ্চ মাত্রায় উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এতে করে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়ের ক্যান্সার সৃষ্টির ঝুঁকি মানদণ্ড ছাড়িয়েছে। যার ভেতর বসবাস করছে রাজধানীর মানুষ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) বলছে গত ৯ বছরে ঢাকার মানুষ ৬২৪ দিন মাঝারি বায়ু, ৮৭৮ দিন সংবেদনশীল বায়ু পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি বলছে গত ৯ বছরের মধ্যে ঢাকায় ২০২৩ এবং ২০২১ সালে খুব অস্বাস্থ্যকর বায়ুমানের দিনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এ সময়ে ঢাকার মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বায়ুতে মানুষ নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, বায়ুদূষণের ফলে ধীরে ধীরে আমরা অসুস্থ জাতিতে পরিণত হচ্ছি। সকলকে নিয়মিত ভাবে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাথে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। আর পরিবেশ উদ্যোগের সমন্বয়ক মাহমুদা ইসলাম বলেন, বায়ুদূষণে প্রতিনিয়ত ঢাকা প্রথম দশটি শহরের মধ্যে থাকার পরেও কোনো সমন্বিত উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। উপরন্তু যেসব আইন বিধিমালা আছে সেগুলো ঠিকমতো মানা হচ্ছে না বরং গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ধীরে ধীরে আমরা এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম জানান, বাংলাদেশের পরিবেশে দূষণের কারণে বাতাসেও বিপজ্জনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে। এক সময় বাতাসে সিসার ঘনত্ব অনেক বেশি ছিল। তারপরে এটি অনেক হ্রাস পায়। আমরা সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৪০০ থেকে ৫০০ ন্যানোগ্রাম পেতাম। কিন্তু এখন আবার এক হাজারেরও বেশি ন্যানোগ্রাম পাওয়া যাচ্ছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, সবুজায়ন যেখানে ২৫ শতাংশ এবং পর্যাপ্ত জলাধার নদী নালা খাল বিল থাকার কথা তা উজাড় করে অপরিকল্পিভাবে নতুন নতুন বাণিজ্যিক ভবন, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এতে করে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীর মধ্যে ঢাকা স্থান পেয়েছে। আগামীতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

অন্যদিকে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, দূষণ সব সময়ই উদ্বেগের। কিন্তু যেসব কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে তার উৎস বন্ধ না হলে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে না। ফলে ধাপে ধাপে উদ্যোগ গ্রহণ না করে স্বল্প কার্যক্রম নিয়ে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত। তাতে এক সময় পরিবেশ রক্ষায় সফলতা আসবে।

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের বায়ুদূষণে উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের একটা ভূমিকা আছে। যদিও শীতকালে পরিবেশ দূষণে এর ভূমিকা থাকে মূল দূষণের প্রায় ৫০ শতাংশ। এর বাইরে কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহন ও ইটের ভাটা দূষণ অন্যতম কারণ। তবে পরিবেশ রক্ষায় সব মন্ত্রণালয়, সরকারি দফতর, অধিদফতর এবং বেসরকারি পর্যায় থেকেও কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

পরিবেশ রক্ষায় বিষয় তুলে ধরে তারা বলেন, পরিবেশ দূষণে মূলত দায়ী, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং বর্জ্য পোড়ানো। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে, যা গ্রিনহাউজ প্রভাব সৃষ্টি করে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করলে কার্বন নিঃসরণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

এদিকে আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।