আজ বিশ্ব ডিম দিবস। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠন, সর্বোপরি ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর ল্েয ১৯৯৬ সাল থেকে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি একযোগে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবারের মতো এবারো প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও ওয়ার্ল্ড’স পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি) যৌথভাবে দিবসটি উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ডিমে আছে প্রোটিন, খেতে হবে প্রতিদিন। দিবসটি উদযাপন উপলে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণিল শোভাযাত্রা এবং দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আজ সকাল ৯টায় রাজধানীর কেআইবি চত্বর থেকে শুরু হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ রাজধানী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ঘুরে আবার খামারবাড়ি কেআইবি চত্বরে গিয়ে শেষ হবে। শোভাযাত্রা শেষে কেআইবির থ্রি-ডি হলে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অন্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ডিমের গুণাগুণসংলিত পোস্টার ছাপানো এবং সেগুলো উন্মুক্ত স্থানে লাগানো। বিভিন্ন এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রমে ডিম বিতরণ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সিদ্ধ ডিম বিতরণ করা হবে।
১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’-এর আয়োজন করে। বিশ্ব ডিম দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বজুড়ে মানুষকে ডিমের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন করা, সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের প্রোটিন ও অপরিহার্য পুষ্টি সরবরাহে ডিমের ভূমিকা তুলে ধরা এবং সব বয়স ও শ্রেণীর মানুষের খাদ্য তালিকায় ডিমকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির বছরে কমপক্ষে ১০৪টি ডিম খেতে হবে। সেই অনুযায়ী দেশে বছরে ডিমের চাহিদা এক হাজার ৮৫০ কোটি ১৬ লাখ পিস। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ৪৪০ কোটি ৬৫ লাখ পিস; অর্থাৎ ডিমের মোট প্রাপ্যতা বেড়ে জনপ্রতি ১৩৭টিরও বেশি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান বাজারে মাছ, গোশত, শাকসবজির অগ্নিমূল্য। গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে গরু, ছাগলের গোশত। মুরগির গোশতেরও কখনো কখনো দাম বাড়ে। মাছের দামও ঊর্ধ্বমুখী। তবে এখনো ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থেকে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে ডিম।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, ডিম সুস্বাদু আর সহজলভ্য এক খাবার; যাকে একটি পরিপূর্ণ খাবার হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ১৩টি পুষ্টিগুণ রয়েছে। ডিমকে বলা হয় ‘গরিবের প্রোটিন’। আবার টেকসই প্রাণিজ প্রোটিনের মধ্যে এর স্থান সবার ওপরে। এ জন্য একে ‘নিউট্রিয়েন্ট পিল’ বলেও অভিহিত করা হয় ডিমকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে অপুষ্টির হার, মা ও নবজাতকের মৃত্যু হার কমেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে খর্বকায় ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যাও কমেছে। এর বিপরীতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ৩০-৪০ বছর আগেও দেশে মাথাপিছু ডিম খাওয়ার সংখ্যা ছিল বছরে গড়ে মাত্র ১০-১৫টি। এক ডিম ভাগ করেও খেতে হতো। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে বর্তমানে প্রতিজনের ডিমের প্রাপ্যতা বছরে ১৩৭টি। দেশে দৈনিক ডিম উৎপাদিত হচ্ছে বছরে প্রায় ছয় কোটি ৬৮ লাখ। ২০৩১ সাল নাগাদ ডিম খাওয়ার ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বছরে জনপ্রতি ১৬৫টি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের প্রাণিসম্পদ খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের জিডিপিতে অবদান ১.৮১ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৩.১৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাতের ধারাবাহিক উন্নতির ফলে গত এক দশকে ডিম উৎপাদনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ডিম উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ৪৪০ কোটি, যা এক দশক আগের তুলনায় প্রায় ২.১৬ গুণ বেশি। গত ৯ অর্থবছরের উৎপাদন প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৩ কোটি; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক হাজার ৫৫২ কোটি; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক হাজার ৭১১ কোটি; ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৭৩৬ কোটি; ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৫৮ কোটি; ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই হাজার ৩৩৫ কোটি; ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই হাজার ৩৩৮ কোটি; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই হাজার ৩৭৫ কোটি এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৪০ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। ডিম উৎপাদনের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি দেশের মানুষের পুষ্টি ও প্রোটিন চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানান।
ডায়েটিশিয়ানদের পরামর্শ অনুসারে, একজন পুরুষ সুস্থ জীবনযাপন এবং পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য প্রতিদিন একটি ডিম খেতে পারেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির এই সফলতা এসেছে সরকারি নীতিসহায়তা, আধুনিক খামারব্যবস্থা, বাচ্চা মুরগি ও খাদ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে।
তবে প্রাণিখাদ্যের মূল্য বেশি থাকায় উৎপাদনকারী করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষুদ্র খামারিদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ে বাজারে। খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে ডিমের পাশাপাশি মুরগির গোশত ও গরুর গোশতের দামও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এ খাতে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের প্রত্য ও পরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর মতায়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। মাত্র চার যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর এ খাতটি এখন অনেকটাই আত্মনির্ভরশীলতার দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে পোলট্রি গোশত, ডিম, এক দিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে দেশীয় পোলট্রি শিল্প। সাধারণ গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে প্রাণিজ আমিষের জোগান দিচ্ছে পোলট্রি শিল্প। বাংলাদেশের প্রান্তিক খামারিরা এখনো মোট ডিম উৎপাদনের বড় অংশ জোগান দিয়ে থাকে। বর্তমানে পোলট্রি শিল্প বিকাশে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে পোলট্রি ফিডের উচ্চমূল্য।