প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের। অতীতে আওয়ামী লীগের সময়ে সাধারণ শিক্ষার সব স্তরেই ধর্মীয় শিক্ষাকে শুধু গুরুত্বহীনই নয়; বরং অনেক ক্ষেত্রে অবজ্ঞাও করা হয়েছে। তবে ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একেবারে শিশু শ্রেণির পর্যায় থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার দাবি ওঠে। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকেও দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানানো হয়। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়। কিন্তু বর্তমানে প্রাথমিকে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনায় দেখা গেছে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষকের কোনো অপশন না রেখে; বরং তার পরিবর্তে সেখানে সঙ্গীত (নৃত্য গান বাজনা) এবং শরীর চর্চা শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্যপদের বিপরিতে শিগগিরই নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর শিক্ষক নিয়োগের জন্য গতকাল রোববার আট সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তবে সেখানে সঙ্গীত এবং শরীর চর্চার শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হলেও দীর্ঘ দিনের দাবি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে কোনো সুযোগ বা অপশন রাখা হয়নি।
গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক এ বি এম ফজলুর রহমান নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে দাবি জানিয়েছি। তিনি বলেন ২০২৪ সালের ১৬ নবেম্বর এবং চলতি বছরের গত ৪ আগস্ট ফেডারেশনের পক্ষ থেকে শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে বেশ কিছু দাবির মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি। উপদেষ্টা মহোদয়ও আমাদের এই দাবির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। আমরা ধারণা করেছিলাম হয়তো বিষয়টির বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু এখন যদি বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে সঙ্গীত এবং শরীর চর্চার শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে বিষয়টি নিয়ে আগামী দিনে জটিলতা দেখা দেবে। শিক্ষক নেতারা আরো জানান, সঙ্গীত বা নৃত্য (গান বাজনা) আমাদের মতো মুসলিম দেশে আবশ্যিক কোনো বিষয় নয়। এ ছাড়া কোনো পরিবারের যদি একান্তই গান বা নৃত্যের প্রতি আগ্রহ থাকে তাহলে তারা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক রেখে টিউশনি বা প্রাইভেটভাবেও বিষয়টি বাচ্চাদের শেখাতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়টি সব ধর্মের জন্যই অতি জরুরি একটি বিষয়। সেকারণেই ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রয়োজনে নতুন পদ সৃষ্টি করে হলেও ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া জরুরি বলে আমরা মনে করি। মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অংশ হিসেবে গতকাল রোববার আট সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব রেবেকা সুলতানা স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে নিয়োগ কমিটি গঠনের তথ্য জানানো হয়েছে। সূত্রমতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে কমিটির চেয়ারম্যান ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালককে (পলিসি ও অপারেশন) সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়াও কমিটিতে রয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (রাজস্ব), উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বিদ্যালয়), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্ম কমিশনের প্রতিনিধি। প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫ অনুযায়ী নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) রাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫-এর প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে ২০ শতাংশ পদ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের দ্বারা এবং ৮০ শতাংশ পদ অন্যান্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের দ্বারা পূরণ করা হবে। আর অন্য ৭ শতাংশ কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য ১ শতাংশ এবং ১ শতাংশ থাকবে শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদের জন্য। তবে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাক্রম অনুযায়ী এসব পদ পূরণ করা হবে। প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে ন্যূনতম স্নাতক। শিক্ষাজীবনের কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণী থাকা যাবে না।
অপর দিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের নিয়োগযোগ্য শূন্যপদের সংখ্যা আট হাজার ৪৩টি। তবে বর্তমানে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কত পদ শূন্য রয়েছে, সে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সঙ্গীত, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকের জন্য পাঁচ হাজার ১৬৬টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব পদে নিয়োগের জন্য আগামী মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হতে পারে। অবশ্য ধর্র্মীয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে গতকাল রাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের জন্য দাবি আমাদের এসেছে বটে কিন্তু যেহেতু ধর্মীয় শিক্ষক পদটি নতুন করে সৃষ্টি করতে হবে সেকারণেই এবার এই নিয়োগে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। আর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে নতুন পদ সৃষ্টি করতে উদ্যোগ নিতে পারে। যেহেতু নতুন পদে সৃজনের জন্য সরকারের অর্থ বিভাগ থেকেও তাদের মতামত নেয়া প্রয়োজন হয় কাজেই বিষয়টি একটু জটিল। তবে সরকার ইচ্ছা করলে নতুন পদ সৃজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।