পিলখানার দুঃসহ ঘটনা আজও বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে অম্লান দাগ হয়ে আছে। যে হত্যাযজ্ঞ সামরিক সমস্যা হিসেবে দ্রুত সমাধানযোগ্য ছিল, তা রাজনৈতিক অদক্ষতা, সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অব্যবস্থাপনার কারণে ভয়ঙ্কর মাত্রা লাভ করে।
যে মুহূর্তে পিলখানায় বিদ্রোহ শুরু হয়, সেই সময় সরকারের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব রাজনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নেয়। হত্যা ও নৃশংসতার প্রাথমিক লক্ষণ স্পষ্ট থাকলেও আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব দেয়া হয় অভিজ্ঞতা-হীন কয়েকজন নেতা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলের হাতে।
এই সময় সময়ক্ষেপণ হতেই হত্যাকারীদের সুযোগ করে দেয়া হয়। বেলা আড়াই ঘটিকায় লালবাগের সুয়ারেজ লাইনের কাছে দু’জন সেনা অফিসারের লাশ উদ্ধার হলেও রাজনৈতিক সমাধানের অযৌক্তিক যুক্তি দিয়ে সেনা ও র্যাবকে সরিয়ে রাখা হয়। এই ভুল সিদ্ধান্তই ছিল হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে ব্যর্থতার প্রধান কারণ। পিলখানা বিডিআর ম্যাসাকার নিয়ে গঠিত স্বাধীন জাতীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। অতি সম্প্রতি সরকারের কাছে সাবেক বিডিআর প্রধান জেনারেল (অব:) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশন এই প্রতিবেদন পেশ করে।
সামরিক বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও সমন্বয়ের অভাব
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেড পিলখানার কাছে পৌঁছলেও তাদেরকে ভিতরে প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়া হয়নি। কমান্ডাররা অপেক্ষা ও সময় ক্ষেপণ করায় হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হয়। এতে উল্লেখ করা হয়-
* অপারেশন ‘রেস্টোর অর্ডার’ বিলম্বিত হয়েছিল, যেটি স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য নির্ধারিত ছিল।
* ট্যাংক এবং ভারী অস্ত্র শহরে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
* সেনাপ্রধান সঠিক সময়ে অপারেশন পরিচালনার জন্য উপস্থিত ছিলেন না। ফলে কমান্ড চেইন ভেঙে যায়।
* ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার চারপাশে কোনো কার্যকর কর্ডন স্থাপন করা যায়নি।
এসব কারণে হত্যা ও লাশ গুম, আলামত ধ্বংস এবং নিরপরাধ পরিবারগুলোর ওপর অত্যাচারের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
পুলিশ ও র্যাবের কার্যকর ব্যর্থতা : প্রতিবেদনে বলা হয়- র্যাবের অগ্রগামী দলগুলো ঠিক সময়ে আক্রমণ করলেও তাদের ভিতরে প্রবেশ বা গুলি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়নি। র্যাবের ডিজি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও এডিজি মেজর জেনারেল রেজানূর খান কার্যকর পদক্ষেপে বাধা দেন।
এতে অপরাধীরা পিলখানা থেকে পালিয়ে যেতে এবং লাশ ও আলামত ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। পুলিশের বিভিন্ন থানা ও র্যাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সঠিক পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও গ্রেফতার কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। এই ভুল, বিলম্ব এবং নীরবতা হত্যাকাণ্ডকে আরো ভয়ঙ্কর করে তোলে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে এটি হয়ে থাকতে পারে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (পরবর্তীতে লে. জেনারেল) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী ও লে. কর্নেল (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান) আজিজ আহমেদ পিলখানা বা যমুনায় অস্বাভাবিকভাবে উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক নেতা ও সংসদ সদস্যদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তীতে তারা উচ্চ পদে পদোন্নতি লাভ করে, তদন্ত প্রভাবিত করার সুযোগ পান এবং বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তার চাকরি শেষ করার ক্ষমতা পান। ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এর পিলখানা হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক অদক্ষতা, সামরিক অনিয়ম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ফল।
কমিশনের মতে- হত্যাকাণ্ড রোধে মূল ব্যর্থতা ছিল সংক্ষেপে: রাজনৈতিক সমাধানের নামে সময়ক্ষেপণ; সেনাবাহিনী ও র্যাবের যৌথ নিষ্ক্রিয়তা এবং কমান্ড চেইনের বিভ্রাট; উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কার্যক্রমে জড়িত থাকা; প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম ও ট্যাংক সরবরাহে বিলম্ব এবং হত্যাকারীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা। ফলশ্রুতিতে, এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সামরিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে সংযুক্ত ব্যর্থতার চরম উদাহরণ হিসেবে আজও স্মৃতিশেষে রয়ে গেছে।
মিডিয়া, সমন্বয়হীনতা ও পরিকল্পিত হত্যার বিশ্লেষণ : ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানার ঘটনা শুধু সামরিক বিদ্রোহ নয়; এটি রাজনৈতিক, মিডিয়া এবং স্থানীয় সমন্বয়হীনতার ফল। হত্যাকাণ্ডের সময় দেশের সুনাম, জাতীয় নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনীর মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নেতিবাচক ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়- আধুনিক যুগে মিডিয়ার প্রভাব অপরিসীম। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ঘটনার সময় বেশ কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া সেনাকর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ও পক্ষপাতমূলক প্রচারণা চালায়। বিদ্রোহীরা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য চিরকুট সাংবাদিকদের হাতে হস্তান্তর করে। এই চিরকুটে বাস্তবতা বিবর্জিত অপপ্রচার ছিল, যা যাচাই না করেই প্রচার করা হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের মধ্যে বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি বৃদ্ধি পায় এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
কিছু সাংবাদিকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা যেমন মুন্নী সাহা এবং এটিএন বাংলার মনজুরুল আহসান বুলবুল ও জহিরুল ইসলাম মামুনের নেতৃত্বে চালানো হয়, যা ষড়যন্ত্রের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়।
কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তহীনতা ও দরবারের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়-
* দরবার হলে অস্ত্রসহ সৈনিক প্রবেশ করলেও ডিজি অনুমতি না দেয়ায় কার্যকর প্রতিরোধ হয়নি।
* সিপাহি ও অফিসাররা আত্মরক্ষার সুযোগ পেলেও শেষ মুহূর্তে তা ব্যবহার করতে পারেননি।
* ফলে হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে দমনের হাতছাড়া হয়ে যায়।
গোয়েন্দা তৎপরতার অভাব প্রসঙ্গে বলা হয়-
* এনএসআই, ডিজিএফআই, র্যাব বা এসবি কোনো কার্যকর তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি।
* পালিয়ে যাওয়া বিডিআর সদস্যদের চিহ্নিত ও আটক করা সম্ভব হয়নি।
কর্ডন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম দায়িত্বহীনতা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়-
* পিলখানা এলাকায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের কার্যকর কর্ডন স্থাপন হয়নি।
* প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে পিলখানার দৃষ্টিসীমার বাইরে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলে, হত্যা চালানো হয়।
* হত্যাকারীরা দেয়াল বা গেট ব্যবহার করে সহজে পালিয়ে যায়।
* বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে হত্যাকাণ্ডের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।
স্থানীয় রাজনৈতিক সমর্থন প্রসঙ্গে বলা হয়-
* স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ণ সমর্থন ও মিছিল আয়োজন হত্যাকারীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পিলখানা থেকে বের হতে সাহায্য করে।
* নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যেমন তোরাব আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা সক্রিয় ভূমিকা নেয়।
হত্যাকারীদের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়-
* বিস্তারিত পরিকল্পনা ও অস্ত্রাগার লুট: দরবারের আগে অস্ত্রাগার ও ম্যাগাজিনে হামলা সব পরিকল্পিত।
* অফিসারদের হত্যার জন্য দ্রুত সমবেত হওয়াও পরিকল্পনার অংশ মনে হয়।
* ডিজির বাংলো ও অফিসারদের বাসস্থানে হামলাও অপরিকল্পিত নয়।
* লাশ গুম, আলামত ধ্বংস, নারী-শিশুদের জিম্মি ও নির্যাতন করা হয়েছে।
* সম্পদ লুট, অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরও ছিল উদ্দেশ্যমূলক।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রধান কারণগুলো হলো- মিডিয়ার দায়িত্বহীনতা ও পক্ষপাতমূলক প্রচারণা; সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তহীনতা; গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার অভাব; সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়হীনতা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহায়তা ও পরিকল্পিত হত্যাকারীদের প্রভাব।
ফলশ্রুতিতে, হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, দেশের সুনাম ও নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জাতির মধ্যে একটি গভীর সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।



