বিনিয়োগকারীদের হতাশা রূপ নিচ্ছে আতঙ্কে

যৌক্তিক কারণ ছাড়াই টানা দরপতন পুঁজিবাজারে

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

পুঁজিবাজার আচরণের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। প্রতিদিনই লেনদেনের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী হওয়া পুঁজিবাজার বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক বিক্রয়চাপে সূচক হারাচ্ছে। গতকাল নিয়ে টানা চার দিন একই আচরণ ঘটল পুঁজিবাজারে। আর এ চার দিনে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচকটির অবনতি ঘটেছে ১৬৩ পয়েন্টের বেশি। সংশ্লিষ্টরা হঠাৎ করে পুঁজিবাজারের এহেন আচরণের পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের মতে, অর্থনীতির সব সূচক এ মুহূর্তে ভালোর দিকে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ক্রমেই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। পুঁজিবাজারও এখন নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে ভবিষ্যতে একটি টেকসই বাজারের আশা করা যায়।

ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল ৫৪ দশমিক ১৪ পয়েন্ট অবনতির শিকার হয়। ৫ হাজার ৩৩৭ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট থেকে দিন শুরু করা সূচকটি দিনশেষে নেমে আসে ৫ হাজার ২৮৩ দশমিক ৭১ পয়েন্টে। একই সময় বাজারটির বিশেষায়িত দুই সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ হারায় যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৪৯ ও ১৪ দশমিক ৯১ পয়েন্ট। দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক এ দিন ৯৮ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট হারায়। ১৫ হাজার ৯৬ দশমিক ৩০ পয়েন্ট থেকে যাত্রা করা সূচকটি দিনশেষে স্থির হয় ১৪ হাজার ৯৯৭ দশমিক ৬৫ পয়েন্টে। সিএসইর দুই বিশেষায়িত সূচক সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের অবনতি ঘটে যথাক্রমে ৬০ দশমিক ১৩ ও ৬১ দশমিক ৯৭ পয়েন্ট।

সূচকের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিদিনই কমছে বাজারের লেনদেনও। ঢাকা শেয়ারবাজারে গতকাল ৫৩০ কোটি টাকার লেনদেন নিষ্পত্তি করে, যা আগের দিন অপেক্ষা ৮১ কোটি টাকা কম। বুধবার বাজারটির লেনদেন ছিল ৬১১ কোটি টাকা। তবে লেনদেন বেড়েছে চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে। এখানে আট কোটি থেকে ২২ কোটি টাকায় পৌঁছে লেনদেন। বরাবরই দিনের শুরুতে বাজারে যে গতি থাকে বিক্রয়চাপ সৃষ্টি হলে সেই গতি আর ধরে রাখতে পারছে না বাজারগুলো। বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি দেখে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এভাবে চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবেন। আর এর ফলে তলানিতে পৌঁছাবে লেনদেন।

এ দিকে সূচকও লেনদেনের অবনতির পেছনে বড় ভূমিকা কিন্তু বিনিয়োগকারীদের। দীর্ঘ মন্দার প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বিনিয়োগকারীরা গত বছরের পটপরিবর্তনের পর একটু বেশিই আশা করেছিলেন। বাজার স্বাভাবিক হওয়ার পর তারা নতুন করে বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম দিকে স্বাভাবিক ছিল বাজার আচরণও। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবার অতীতের বাজার খেলোয়াড়রা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে আবার পূর্বের জুয়ার টেবিলে পরিণত হয় এটি। নামসর্বস্ব কয়েকটি কোম্পানি নিয়ে চলতে থাকে কারসাজি। মৌলভিত্তির বিচারে যেসব কোম্পানির শেয়ারদর ৬০ টাকা হওয়ার কথা নয় সেটি উঠে যায় ৬০০ টাকায়। যেটি ৪০ টাকায়ও বিনিয়োগকারীদের কেনার কথা নয় সেটি বেচাকেনা হচ্ছে ৪০০ টাকায়। এভাবে ডজনখানেকের বেশি কোম্পানি শুধু মূলধন বিবেচনায় এখন বাজারে রাজত্ব করছে। প্রতিদিনই লেনদেনও মূল্যবৃদ্ধিতে এগুলোই থাকছে তালিকার শীর্ষে। এতে বিনিয়োগকারীরা স্বাভাবিক বাজার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা তাদের মধ্যে তৈরি করেছে হতাশা। আর এ মুহূর্তে ক্রমেই আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে।

গতকাল মতিঝিলে ডিএসইর বিভিন্ন ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কয়েকটি ট্রেডিং হাউজে গিয়ে বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা বললে তারা তাদের এ হতাশার কথা তুলে ধরেন। নয়া দিগন্তকে তারা বলেন, একটি বাজারে মাসের পর মাস কিভাবে কয়েকটি নামসর্বস্ব কোম্পানির টানা মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে। এসব কোম্পানির অতীত ইতিহাস, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা থাকলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু মৌলভিত্তির কাছে না থাকা সত্ত্বেও কিভাবে একটি কোম্পানির শেয়ার দর দুই মাসে ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ বাড়তে পারে? অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ এগুলোর বিরূদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কোম্পানি যেগুলোর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার বেচাকেনা হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকায়। এগুলোর মূল্যবৃদ্ধিতে একমাত্র বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে স্বল্প মূলধন। এ বাজার থেকে কী আশা করা যায়?

একজন বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেন, গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফ্যাসিবাদের এক দোসর সামিট গ্রুপের, যারা বিভিন্নভাবে পুঁজিবাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে তাদের সব শেয়ারের দর তলানিতে এসে ঠেকে। গ্রুপটির জ্বালানি খাতের দু’টি কোম্পানির মধ্যে একটি কোম্পানি ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যটি কোনোভাবে টিকে আছে। তাদের কোম্পানির শেয়ার নিয়েও এখন চলছে কারসাজি। সাম্প্রতিক সময়ে সামিট গ্রুপের সেবা খাতের একটি কোম্পানি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের শেয়ার দর ১৭ টাকা থেকে ৪৫ টাকার পৌঁছে গেছে। বিগত কয়েক দিনের টানা দরপতনের মধ্যেও কোম্পানিটির শেয়ার দর কমছে না, বরং প্রতিদিনই কমবেশি বেড়ে চলেছে; অথচ বাজারের মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির তালিকায় থাকা কোম্পানিগুলো প্রতিদিনই কমবেশি দর হারাচ্ছে। তাই তাদের মতে, এ বাজারে টিকে থাকার সুযোগ নেই।

গতকাল পুঁজিবাজার সূচকের বড় অবনতির পেছনে ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের দুর্বল কোম্পানির ব্যাপক দরপতন। গত কয়েক দিন যে দুর্বল ব্যাংকগুলোর শেয়ার দর বাড়ছিল, গতকাল এগুলোতে ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই ঘটনা ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও। ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণায় এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে দর হারায়। ফলে গতকাল ডিএসইতে দরপতনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির সবই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর মূলধন সমৃদ্ধ হওয়ায় এ দুই খাতের দরপতনে সূচকের বড় অবনতি ঘটে।