জাতীয় সংলাপ : জুলাই বিপ্লব ও বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে নির্বাচন ঝুলে যেতে পারে

Printed Edition
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে পলিসি প্লেনামের জাতীয় সংলাপে আলোচকরা : নয়া দিগন্ত
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে পলিসি প্লেনামের জাতীয় সংলাপে আলোচকরা : নয়া দিগন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে এই দেশ সঙ্কটে পতিত হবে এবং আগামী নির্বাচনও ঝুলে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর দিলারা চৌধুরী। গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির মিলনায়তনে জুলাই বিপ্লব ও বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশবিষয়ক জাতীয় সংলাপের প্রথম দিনের আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে আদর্শগত অবস্থান ছিল। বর্তমানের দেশ এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছে, হয় আমরা ঘুরে দাঁড়াব, নয়তো বিলীন হয়ে যেতে হবে। কারণ আমাদের পরিচয়গত সঙ্কট তৈরি হয়েছে। আমাদের এই সমাজকে শেখ মুজিবুর রহমান বিভক্ত করেছেন। তিনি দেশে এসেই স্বাধীনতাযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের বলে ভাগ করে দিয়েছিলেন। তিনি তখন দেশ ত্যাগ না করলে স্বাধীনতার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

তিনি আরো বলেন, ভারত তাদের সেভেন সিস্টারের জন্য আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক রাখতে পারত, যার স্বপ্ন দেখেছেন শহীদ জিয়াউর রহমান সার্কের মাধ্যমে। কিন্তু তারা তা না করে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইল, যা এদেশের মানুষ কিছুতেই মানতে চায়নি। তা ছাড়া ২০২৪ সালের আন্দোলনে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এদেশের মানুষ ভারতের কোনো ধরনের আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম মেনে নিতে নারাজ। এই আন্দোলন হয়েছে জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, এই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল নতুন করে রাষ্ট্রকে গঠন করা। সেদিন ক্যান্টনমেন্টে বসে একটি সরকার গঠন করা হলেও সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও ছিল। তখন বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারেনি, যা একটা ভুল ছিল। তখনই সরকারব্যবস্থার সঙ্কট তৈরি হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধান ভেঙে দিয়ে নতুন করে ঢেলে সাজানো। কিন্তু তা হয়নি। সেদিন ক্যান্টনমেন্টে বসে চক্রান্ত হওয়ার কারণে এখন আমরা সমস্যায় পড়ে গেছি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মানবাধিকার সংগঠক জায়েদুল করিম চৌধুরী পলাশ বলেন, এই সরকারের পরিচয়গত সঙ্কট রয়েছে। তারা বলতে পারছে না এটি কোন ধরনের সরকারব্যবস্থা। যদিও বিপ্লবী সরকার হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হয়নি। এই সরকার ঘোষণাপত্রের কিছুই করতে পারেনি। অন্যদিকে জুলাই সনদের জন্য ঐকমত্য হয়নি। জুলাই সনদ হলেও তার আইনি ভিত্তি না থাকলে কোনো কাজে আসবে না। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে কিন্তু তারা এখনই আওয়ামী লীগের মতো আচরণ করছে। এতে করে তারা এলেও এক বছরের বেশি থাকতে পারবে বলে সন্দেহ হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধের সাথে জুলাই সনদের সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু তা ঠিক না। ভবিষ্যতে কেউ আওয়ামী লীগের মতো কার্যক্রম করলে আবারো বিপ্লব হতে পারে। তবে জুলাই সনদ নিয়ে এত কিছু হলে নির্বাচন কেমন হবে বুঝাই যাচ্ছে।

সংলাপে কর্নেল (অব:) মো: জাকারিয়া হোসেন বলেন, ২০২৪-এর পরিবর্তন শুধু একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়; এটি একটি নতুন, উজ্জ্বলতর অধ্যায়ের সূচনা। আমরা আজ একটি ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে আছি। একটি পথ আমাদের নিয়ে যেতে পারে পুরনো ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তির দিকে, আর অন্যটি আমাদের নিয়ে যেতে পারে একটি উদার, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের দিকে। এই পথ চলায় আমাদের দায়িত্ব হবে সুশাসন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি আমাদের সবার অটল অঙ্গীকার। এটি কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়; এটি আমাদের সবার-রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী এবং প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।

জাতীয় সংলাপের আহ্বায়ক, সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিব আলি বলেন, ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে আনা ও তাদের প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলে সমাজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা তখন ভাববে আমি যদি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করি, আমিও একদিন ভালো চাকরি বা সম্মানজনক অবস্থানে যেতে পারব। দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেই সুযোগ-সুবিধা মেলে, পড়ালেখা নয়। এখন অনেকে বলে পড়াশোনা করব কেন? আওয়ামী লীগে বা বিএনপিতে গেলে তো সুযোগ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে দেশের বর্তমান দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান থাকবে আপনারা শিক্ষাকে মর্যাদা দিন। যদি রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, এমনকি শিক্ষকের পা ধরে সালাম করেন তাহলে দেখবেন, পুরো সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সেক্রেটারি ফেরদৌস আরা খানম বলেন, শিক্ষকের ভূমিকা কেবল ‘জ্ঞানদাতা’ হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং ছাত্রের ম্যানেজার বা গাইড হিসেবে কাজ করা উচিত। এই নতুন ভূমিকায় শিক্ষক তার আদর্শ, চরিত্র এবং কথার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পথনির্দেশনা দেবেন যাতে সেই প্রভাব তাদের আত্মায় প্রতিফলিত হয় এবং তারা শিক্ষার বাস্তবতা অন্তরের সাথে উপলব্ধি করতে পারে। এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আদর্শ প্রভাবের প্রসার ঘটানো জরুরি। একইসাথে শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ অ্যাসাইনমেন্ট, একটি সমন্বিত ক্লাসরুম এবং সিলেবাস ও কারিকুলামকে স্কিল-বেসড ও কনফিডেন্স-বেসড করে তৈরি করা দরকার।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে সবচেয়ে বেশি দরকার ধর্মীয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কযুক্ত কারিকুলামকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একে প্রাধান্য দেয়া। কারণ সততা, সহনশীলতা, দেশপ্রেম ও মানবিকতা এই মূল্যবোধগুলো থেকেই একজন ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। দেশপ্রেম তৈরির জন্য প্রত্যেকের শিক্ষার সাথে সততা, সহনশীলতা, পরশ্রদ্ধা ও দেশপ্রেম ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা আবশ্যক, আর এই মূল্যবোধগুলো শিক্ষার মধ্যে সম্পৃক্ত করার জন্য নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমী বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ্যবস্থা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এটি এখন একটি বহুমুখী ও অগোছালো ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যার কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বা জাতীয় লক্ষ্য নেই। শিক্ষার মাধ্যমে যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞান, মূল্যবোধ, কৌতূহল ও সৃজনশীলতা বিকশিত হওয়ার কথা, সেখানে বরং এই ব্যবস্থা তাদের চিন্তা ও অনুসন্ধানী মনোভাবকে দমন করছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একজন মানুষকে নৈতিকভাবে সৎ, মূল্যবোধে উজ্জীবিত এবং সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাধ্যতামূলক আরবি ও ইসলামিয়াত শিক্ষা তুলে দেয়া হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা। পরে জিয়াউর রহমান এই বিষয়গুলো আবার চালু করলেও তা যথেষ্ট কার্যকর হয়নি।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি উল্লেখ করে আজমী বলেন, এখানে জাতীয় পাঠ্যক্রম, ইংরেজি মাধ্যম, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড ও বিভিন্ন ধারার মাদরাসা, দাখিল, কওমি, হেফজ সব মিলিয়ে; এক বিশৃঙ্খল ধারা তৈরি হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার কোনো একক জাতীয় মানদণ্ড নেই। শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী, কিন্তু তাদের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা পরিবার ও বিদ্যালয় উভয় জায়গাতেই দমন করা হয়। ‘চুপ করো’ সংস্কৃতির কারণে তাদের জানার আগ্রহ অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি মুখস্থনির্ভর; এখানে সৃজনশীল চিন্তা, বিশ্লেষণ বা নিজের মতপ্রকাশের সুযোগ নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা অর্জন করেও বাস্তব জ্ঞান, যেমন ইংরেজিতে রচনা লেখা বা সাবলীলভাবে কথা বলার মতো মৌলিক দক্ষতায় পিছিয়ে থাকে। এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার কারণেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়েছে, আর উন্নত দেশগুলো জ্ঞানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই ব্যবস্থাকে সামান্য সংস্কার করে ঠিক করা সম্ভব নয়; একে সম্পূর্ণ ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।

মাহসিনা মমতাজ মারিয়া বলেন, দেশের জনগণকে প্রকৃত অর্থে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল আধুনিকায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘদিন ধরে ‘ব্রেইন ড্রেইন’ নামের এক প্রবণতা চালু রয়েছে, উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের মেধাবীরা বিদেশে পাড়ি জমায়, কিন্তু অনেকে আর ফিরে আসে না। ফলে দেশের সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। এই প্রবণতা বদলাতে হলে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী মেধাবীদেরকেও শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরে সম্পৃক্ত করতে হবে, মন্তব্য করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে চীন হতে পারে একটি কার্যকর রোল মডেল। তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে দেশী ও বিদেশী গবেষকরা যৌথভাবে কাজ করেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন গ্লোবাল সেন্ট্রাল হাব গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে বিদেশী গবেষকদেরও অংশগ্রহণ এবং অ্যাকসেস থাকবে।