১৪ বছরে ২ হাজার ১১০ কোটি টাকার দুর্নীতি

জলবায়ু তহবিল নিয়ে টিআইবি: অনুমোদিত ৮৯১টি প্রকল্পের মধ্যে ৫৪ শতাংশ বরাদ্দে দুর্নীতি

Printed Edition
রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ড. ইফতেখারুজ্জামান : নয়া দিগন্ত
রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ড. ইফতেখারুজ্জামান : নয়া দিগন্ত

বিশেষ সংবাদদাতা

জলবায়ু পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় গঠিত সরকারের নিজস্ব তহবিল বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট (বিসিসিটি) ফান্ডের ৫০ শতাংশেরও বেশি নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা জাতীয় জলবায়ু তহবিলে ১০ বছরে ২ হাজার ১১০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, জলবায়ু অর্থায়নে জাতীয় তহবিলের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দুর্নীতিতে নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিসিসিটি থেকে অনুমোদিত ৮৯১টি প্রকল্পের মধ্যে ৫৪ শতাংশ বরাদ্দে দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাক্কলিত এই পরিমাণ প্রায় ২৪৮ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২ হাজার ১১০ কোটি টাকার বেশি।

রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ মাইডাস সেন্টারে ‘বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো: মাহ্ফুজুল হক এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মো: সহিদুল ইসলাম।

সংস্থাটি জানায় জলবায়ু তহবিল বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যর্থ। ফলে একদিকে চাহিদার তুলনায় নগণ্য তহবিল বরাদ্দের ব্যাপক অপচয়, অন্য দিকে এসব বরাদ্দ ও প্রকল্পের উপযোগিতার অভাব বিসিসিটিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। যার কারণে ভবিষ্যতে জলবায়ু খাতে অর্থ বরাদ্দ হ্রাস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপশি দুর্নীতির ফলস্বরূপ প্রকৃত ঝুঁকিগ্রস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদে সরকারি বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হবে। গবেষণার ভিত্তিতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য ৯ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিসিসিটি থেকে মোট ৪৫৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ অনুমোদিত হয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি বরাদ্দ দুর্নীতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক বিবেচনা, যোগসাজশ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্প অনুমোদনের প্রবণতা স্পষ্ট। অথচ তহবিল ব্যবস্থাপক হিসেবে বিসিসিটির কর্মকর্তারা অনিয়ম রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রয়োজন ১২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তহবিল মিলিয়ে বছরে গড়ে বরাদ্দ এসেছে মাত্র ৮৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। প্রয়োজনের মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। জাতীয় তহবিল থেকে বরাদ্দ প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হারে কমেছে। বিপরীতে আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে বরাদ্দ বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। তবু বরাদ্দের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সীমিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় তহবিলের প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যর্থতা নিয়মিত ঘটনা। ৮৯১টি প্রকল্পের মধ্যে ৫৪৯টির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। গড়ে ৬৪৮ দিনের প্রকল্প শেষ হতে লেগেছে ১ হাজার ৫১৫ দিন, অর্থাৎ ১৩৩ শতাংশ সময় বৃদ্ধি। কোনো কোনো চার বছর মেয়াদি প্রকল্প শেষ হতে লেগেছে ১৪ বছর পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক তহবিলেও একই চিত্র, ৫১টি প্রকল্পের মধ্যে ২১টির মেয়াদ গড়ে ৫২ শতাংশ বেড়েছে।

তহবিলে অনিয়ম দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, অর্থ বরাদ্দে বেশি বিপদাপন্ন এলাকা কম গুরুত্ব পেয়েছে। অভিযোজনের সাথে সম্পর্কহীন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের অর্থে সাফারি পার্ক, ইকো পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। নি¤œমানের কাজ সম্পাদন করা হয়েছে এবং অর্থ জালিয়াতি করা হয়েছে, এমনকি প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়ন এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য বাজেট বরাদ্দ, চাহিদা, ভৌগোলিক বাস্তবতা ও পরিকল্পনা নীতির সাথে সঙ্গতিহীন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

গবেষণাটির সুপারিশে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০ সংশোধন করতে হবে, তহবিলের তদারকি ও নিরীক্ষার জন্য পৃথক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং অনিয়ম দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিচার করতে হবে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় তহবিলের অর্থ লুটপাট করেছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। জবাবদিহি, সুশাসন ও দক্ষতার অভাবের কারণেই এই লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই। জলবায়ু অর্থায়নে প্রকৃত উপকারভোগীদের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার এবং বিশেষজ্ঞদের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত প্রকল্পে মোট বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মোট বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার। এই নগণ্য পরিমাণ অর্থও স্বচ্ছতার সাথে ব্যয় করা হয়নি। বরং রীতিমতো লোপাট হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট মোকাবেলায় বিদেশী অর্থায়নের প্রত্যাশিত প্রবাহ না থাকায় দেশীয় অর্থায়ন একধরনের আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ গবেষণা থেকে যা প্রকাশিত হলো তা একান্তই বিব্রতকর। সরকারি অর্থায়ন যতটুকু ছিল তার বেশির ভাগ, ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ বা অপচয় করা হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে। গত ১৬ বছরের চৌর্যতন্ত্রের সার্বিক লুটপাটের তুলনায় এই পরিমাণ কম মনে হলেও আদতে তা এ খাতের সরকারি তহবিলের ৫৪ শতাংশ। তবে এই কারণে সরকারি অর্থায়নে জলবায়ু প্রকল্পের গুরুত্বের অবমূল্যায়নের সুযোগ নেই বরং সরকারি বরাদ্দ আরো বৃদ্ধি করতে হবে।