ডিসি-এসপিদের উদ্দেশে সিইসি

আইনের শাসন কাকে বলে দেখিয়ে দিতে চাই

Printed Edition
ডিসি-এসপিদের সাথে মতবিনিময় সভায় (ইনসেটে) বক্তব্য রাখেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন : নয়া দিগন্ত
ডিসি-এসপিদের সাথে মতবিনিময় সভায় (ইনসেটে) বক্তব্য রাখেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন : নয়া দিগন্ত

বিশেষ সংবাদদাতা

  • এআই এবং অপতথ্য প্রচার বড় চ্যালেঞ্জ

  • একই দিনে দুই নির্বাচন কঠিন হবে

  • চিহ্নিত অপরাধীদের জামিন রোধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বড় চ্যালেঞ্জ

  • সীমান্তে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে

  • ২০২৬-এ মডেল নির্বাচনের দৃষ্টান্ত গড়ার অঙ্গীকার

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আমি বেশ কিছু দিন আগে সম্ভবত এটা বলেছিলাম যে, আইনের শাসন কাকে বলে আমরা দেখিয়ে দিতে চাই। কারণ আমাদের ওপর সামষ্টিকভাবে একটা ব্লেম করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছি। আমরা একটা ম্যানেজ ইলেকশন করেছি। এই অপবাদ থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা প্রমাণ করতে চাই যে, আমরা সঠিক সুন্দর নির্বাচন করতে পারি। তিনি বলেন, এটি সম্ভব কেবল আইনের শাসনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন মিলনায়তনে গতকাল ডিসি-এসপি, বিভাগীয় কমিশনার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাথে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় এ আহবান জানান সিইসি। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এ সভায় সিইসি বেলা ২টায় তার মূল বক্তব্য দেন। নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে চার নির্বাচন কমিশনারও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ৮ বিভাগীয় কমিশনার, আইজিপি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, ৬৪ জেলা প্রশাসক (ডিসি), ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), ৮ রেঞ্জের ডিআইজি, ৬৪ জন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ১০ জন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিলিয়ে মোট ২২৬ জন এ দিন সভায় অংশ নেন।

সভার শুরুতে সিইসি সম্প্রতি দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত শরিফ ওসমান বিন হাদির রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। সকালে স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, মাঠ কর্মকর্তারা ভালো কাজ না করলে ইসির ‘ঘুম হারাম’ হবে। কর্মকর্তাদের সাথে কয়েক ঘণ্টা মতবিনিময় করে ‘আশ্বস্ত’ হওয়ার কথা জানিয়ে সমাপনী ভাষণে ‘বুকের জোর’ বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আপনারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। আমি আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, যে উদ্দেশ্যে আজকে এখানে একত্র হয়েছি, সে উদ্দেশ্য আমরা ডেলিভার করতে পারব।’

ডিসি-এসপিদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, আমাদের ওপর একটা জাতীয় দায়িত্ব এসে পড়েছে। এটি শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব আবার কনস্টিটিউশনাল রেসপন্সিবিলিটিও (সাংবিধানিক দায়িত্ব)। আমরা এখানে যারা উপস্থিত হয়েছি তারাই সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে কার্যত মাঠ পর্যায়ে সরকারকে এবং দেশটাকে সচল ও সুশৃঙ্খল রাখেন। এই আপনারা বুক ফুলিয়ে যখন আমাকে সাহস দেবেন, আমিও তখন সাহসী হবো। আপনাদের অঙ্গীকারই আমাকে সাহসী করে তোলে। আপনারা যখনই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নেবেন, বিধিবিধানের আলোকে কাজ করবেন; ইনশাআল্লাহ নির্বাচন কমিশন তখনই আপনাদের পাশে থাকবে।

তিনি বলেন, আইনের শাসন কাকে বলে আমরা তা দেখিয়ে দিতে চাই। আইনের শাসন মানে আইন হবে অন্ধ। ‘ল’ (আইন) সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করবেন। আপনাদের ওপর গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমরা দায়ী থাকব।

সিইসি বলেন, ‘দুইজন ব্যক্তি আমাদের কাছে ভিভিআইপি; যদি কোনো আইন থাকত, আমি ভিভিআইপি ঘোষণা করতাম এই মুহূর্তে। একজন রিটার্নিং অফিসার, আরেকজন প্রিজাইডিং অফিসার।’

ইসির সব সার্কুলার, পরিচালনা বিধিসহ সব আইন-বিধি, নির্দেশনা রিটার্নিং অফিসারকে ভালোভাবে পড়ে নেয়ার পাশাপাশি প্রিজাইডিং অফিসারদের ‘গাইড করার’ নির্দেশনা দেন তিনি।

ইতিবাচক প্রচার চালাতে হবে : আচরণবিধি প্রতিপালন, জরিমানা ও প্রতিটি ‘অ্যাকশন’ এর বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের সাথে সমন্বয় করে ইতিবাচক প্রচারণা চালানোর ওপর জোর দেন সিইসি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই যে এখন সক্রিয়, সে বিষয়টি তুলে ধরে যে কোনো ধরনের অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য ও গুজব রোধের পাশাপাশি ভালো উদ্যোগের

প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সবার সহযোগিতা চান তিনি।

সিইসি বলেন, ‘ঢাকা পোস্টারে ছেয়ে গেছে, এটা দেখা যাচ্ছে। আপনারা যে সরাচ্ছেন, রিমুভ করছেন- সেটির কোনো খবর নেই। প্রতিটি অ্যাকশন, প্লিজ গিভ পাবলিসিটি। আপনার অফিসে এত লোক আছে, সবাই তো সারারাত বসে ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফ্যামিলি মেম্বারকে বলে দিন- ‘এটা দিয়ে দাও’। ‘আপনি ছেলেকে বলেন, আপনার মেয়েকে বলেন। আপনার বাসায় যারা আছে কাজের মেয়ে পর্যন্ত ফেসবুক চালায় আজকাল। সুতরাং আপনারা যে কাজটা করছেন, এটা পাবলিশ করতে হবে।’ অভিযোগ পেলে তার সুরাহা করতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে তৎপর হওয়ার তাগিদ দেন নাসির উদ্দিন। ভোটের মৌসুমে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে তা রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার কিংবা নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে জানানোর নিয়ম। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ আসা শুরু করেছে বলে জানান সিইসি।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ : সম্প্রতি ময়মনসিংহে একজনকে পুড়িয়ে মারা ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশনা দেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন।

প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কমিউনাল হারমনি মাস্ট বি মেনটেইন। এটা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রাখতে হবে। আর বয়স্ক, ফিজিক্যালি ডিজঅ্যাবল যারা আছেন, তারা যেন কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারেন এই ব্যবস্থাটা করতে হবে।’ ভোটের সময় সংখ্যালঘুরা যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সিইসি বলেন, ‘দুর্গাপূজা ও ইলেকশনে তাদের ভয়ের কথা বলেছে। মাইনোরিটি কমিউনিটির নেতারা বলেছেন, দুর্গাপূজা এলে তাদের ওপরে আক্রমণ হয়, মূর্তি ভাঙা হয়; তবে এবারের মতো সুন্দর করে পূজা উদযাপন আমরা জীবনে করতে পারি নাই। আমি বলেছি, ইলেকশনও ইনশাআল্লাহ এরকম হবে।’

তিনি বলেন, ‘মাইনোরিটি কমিউনিটির যারা ভোট দিতে আসতে চান, তারা যাতে সেইফলি আসতে পারে; শান্তিপূর্ণভাবে আসতে পারে, ভোটটা দিতে পারেন; দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারেন এবং শান্তিতে ঘুমাতে পারেন, সে ব্যবস্থা আপনাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। এটা ভেরি ইম্পর্টেন্ট।’

পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থা বিশ্বসেরা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাকে খুশি করার দরকার নেই। আপনারা আপনাদের অধীনস্থদের আইনের মাধ্যমে পরিচালনা করবেন। সিস্টেম যাতে ঠিক মতো ডেলিভারি দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা আপনাদেরই করতে হবে। কোনো ধরনের বিচ্যুতি যেন না ঘটে, সে দিকে কঠোর নজর রাখতে হবে।

মাঠের প্রশাসকরা যা বললেন : আগামী সংসদ নির্বাচন ও গণভোট ঘিরে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টিতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজিরা। তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সীমান্ত নিরাপত্তা আরো জোরদার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তিক প্রযুক্তির (এআই) অপব্যবহার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে একদিকে চিহ্নিত অপরাধীদের জামিন রোধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার নির্বাচনের জন্য চ্যালেঞ্জ। এ জন্য কঠোর পদক্ষেপের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। সেই সাথে একটি ‘মডেল নির্বাচন’ উপহার দিয়ে ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই এখন প্রশাসনের মূল লক্ষ্য বলে জানান জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা। ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি বলেন, আমরা সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। আইজিপির নির্দেশে দেশের পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে। দলমত নির্বিশেষে আমরা অন্যায়ভাবে কাউকে কিছু করতে দিবো না। বাংলাদেশে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে থাকবে।

পুলিশ সুপাররা বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে আসামিসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করছি। আমাদের পর্যাপ্ত যানবাহন সঙ্কট রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল সঙ্কটের কারণে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় না। জনবল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একই দিনে দুটি নির্বাচন বড় একটা চ্যালেঞ্জ হবে। তারা বলেন, নির্বাচনের দিন অসুস্থ, প্রতিবন্ধী মানুষগুলো ভোট দিতে গেলে পুলিশকে বলা হয় সহযোগিতা করার জন্য। এখানে এই কাজে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মীদের রাখা গেলে পুলিশের কাজে সহযোগিতা হবে। তারা আরো জানান, বিগত নির্বাচনগুলোতে পুলিশের যে বাজেট ছিল এটায় বৈষম্য ছিল। এই নির্বাচনে বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করছি। এ ছাড়া তারা পুলিশের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার জন্য জোর দাবি জানান।