সম্ভাব্যতা যাচাইহীন প্রকল্প কম বরাদ্দে কাজ বাধাগ্রস্ত

সার্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন

যাচাই ছাড়াই গ্রহণ ও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের প্রকল্প। ফলে সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে নানা ধরনের জটিলতা ও সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের সার্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন-২ প্রকল্পটিরও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি।

Printed Edition
স্থানীয় সরকার বিভাগ
স্থানীয় সরকার বিভাগ |ইন্টারনেট

হামিদুল ইসলাম সরকার

তড়িঘড়ি ও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নেয়া দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের অনেকগুলোরই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের বিধান পালন করা হয় না। যাচাই ছাড়াই গ্রহণ ও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের প্রকল্প। ফলে সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে নানা ধরনের জটিলতা ও সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের সার্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন-২ প্রকল্পটিরও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, কবরস্থান, শ্মশানঘাট নির্মাণ করার কথা। তবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ কম দেয়া প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। বরাদ্দ যে হারে এগোচ্ছে এই ধারা অব্যাহত থাকলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি। এ দিকে প্রশ্ন উঠেছে, প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন মিটিংয়ে সম্মানী বাবদ মাসে ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৯১ লাখ টাকা।

প্রকল্পের স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, গ্রামীণ অর্থনীতি বেগমান ও সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সমাজের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে গ্রামীণ বা সামাজিক অবকাঠামোগুলোর উন্নয়ন আবশ্যক। সার্বজনীন সামাজিক অবকাঠামোগুলো যেমন: কবরস্থান, শ্মশান, মসজিদ, মন্দির, চার্চ, প্যাগোডা, গুরুদুয়ারা ও ঈদগাহ উন্নয়ন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সাথে সাথে বিদ্যমান সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, পুনর্নির্মাণ, মেরামত ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তায় নতুন আঙ্গিক দেয়ার মাধ্যমে সামাজিক সেবা জনসাধারণের উপযোগী করে তোলা প্রয়োজন। এ ছাড়াও বন্যার সময়ে প্লাবিত হাওর এলাকায় লাশ সৎকার করা যায় না। কিন্তু একটি উঁচু ও সংরক্ষিত খাস জমিতে বা দানকৃত জমিতে লাশ সৎকারের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হলে সামাজিক বন্ধন অটুট রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও সম্প্রসারণ সরকারের অগ্রাধিকার কার্যতালিকায় অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। ফলশ্রুতিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২০২২ সালের ২২ মার্চ একনেক থেকে এক হাজার ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। যা জুলাই ২০২২ থেকে শুরু হয়ে জুন ২০২৬ সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বলা হয়েছে, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা তথা সামাজিক সেবার প্রতিশ্রুতি রক্ষার সাথে সাথে কর্মসংস্থান ঘটাবে ও দরিদ্রতা হ্রাস করবে। সমগ্র বাংলাদেশে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য : স্থানীয় পর্যায়ে সমাজের কল্যাণ ও সংহতি সুসংহত করতে ১৭ হাজার ৩২১টি সামাজিক এবং ধর্মীয় অবকাঠামো উন্নয়ন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, মন্দির, চার্চ, প্যাগোডা, কবরস্থান, শ্মশানঘাট ইত্যাটি অবকাঠামো নির্মাণ। আর স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।

ব্যয়ের হিসাব : ডিপিডিতে দেয়া খরচের হিসাব থেকে দেখা যায়, প্রকল্পে আউটসোর্সিং কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলে মোট ১৩৪ জনের বেতন খাতে ব্যয় ২০ কোটি টাকা। চার বছরের জন্য দু’জন পরামর্শকের পেছনে ব্যয় দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকা। পিইসিসহ বিভিন্ন মিটিংয়ে সম্মানী খাতে চার বছরে খরচ হবে এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ফলে প্রতি মাসে এই খাতে ব্যয় হবে তিন লাখ ৯১ হাজার টাকা। ১৭ হাজার ৩২১টি স্থাপনার জন্য ব্যয় এক হাজার কোটি টাকা। ২৫ হাজার টাকাদরে ৯০টি টেবিল কিনতে খরচে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৯ হাজার টাকা দরে ৮৬টি কম্পিউটার টেবিল কিনতে যাবে সাত লাখ ৭৮ হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকা দরে ২১০টি চেয়ার কেনা হবে ২১ লাখ টাকায়। ২১ হাজার টাকা দরে ২৬টি ফাইল কেবিনেট কিনতে যাবে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ১৮ জনের ভ্রমণব্যয় ৮০ লাখ টাকা। এখানে জনপ্রতি খরচ চার লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিস্থিতি : প্রকল্পের বিভিন্ন অর্থবছরের বাস্তবায়ন অগ্রগতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে নির্ধারিত বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ থাকলেও প্রকৃত অগ্রগতি হয়েছে ১১.৭১ শতাংশ। যার প্রধান কারণ এডিপিতে বরাদ্দ বেশি পাওয়া। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকৃত বরাদ্দ ছিল ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। কিন্তু ওই অর্থবছরে অন্যান্য প্রকল্পের ব্যয় সঙ্কুলান হওয়ায় আলোচ্য প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের সক্ষমতা থাকায় সরকার থেকে আরো ৬৩ কোটি ৬৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১১.৭১ শতাংশে দাঁড়ায়। পরবর্তী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৩ শতাংশ। কিন্তু এডিপিতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত না থাকায় প্রকৃত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৮.৬৪ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। একইভাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের (এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৩৩ শতাংশ থাকলেও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ১৭.৮৪ শতাংশ, যা পর্যাপ্ত এডিপিতে বরাদ্দ না থাকার কারণে প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না। প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে মোট অগ্রগতি ২২-২৫ শতাংশ এর মধ্যে থাকতে পারে বলে আইএমইডির পর্যবেক্ষণ।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যা বলছে : বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকাশ গণ কেন্দ্র প্রকল্পটি সম্পর্কে বলছে, ভবিষ্যতে সমজাতীয় প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে ফিজিবিলিটি স্টাডি গ্রহণ করতে হবে।

প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী অর্থবছরভিত্তিক আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা যথাযথভাবে অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে এডিপি বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রকল্পের অগ্রগতি অনুযায়ী জুন ২০২৬ সালের মধ্যে সব স্কিম সম্পন্ন করতে সময়ের কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের অধীনে যেসব ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সুবিধাভুক্ত সব ক্ষেত্রে সেগুলো চিহ্নিত করতে প্রকল্পের অর্থায়নে সাইনবোর্ড বা নামফলক স্থাপন করলে উন্নয়নকার্যক্রমের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। প্রকল্পের বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও, কিছু চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যেমন বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার, স্কিম বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ, জনবল সঙ্কট এবং দুর্গম এলাকায় পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে কমিটির ওপর নির্ভরশীল হওয়া।

যা বলছে আইএমইডি : প্রকল্পের বাস্তবায়নের ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রকল্পের সমাপ্তি নির্ধারিত থাকলেও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এখন পর্যন্ত মোট প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৫৯.৫৮ শতাংশ হয়েছে, যা পরিকল্পিত ১০০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এজন্য প্রকল্পের সফল সমাপ্তি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দফতরের সাথে সমন্বয় করে পর্যাপ্ত এডিপি বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।