পোশাকের অর্ডার হারাচ্ছে চীন, ভারত নতুন আদেশ আসছে বাংলাদেশে

শাহ আলম নূর
Printed Edition

ট্রাম্পের শুল্কারোপে বেশ বেকায়দায় পড়েছে চীন এবং ভারত। এমন পরিস্থিতিতে নতুন রফতানি আদেশ আসছে বাংলাদেশের দিকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) প্রভাবকে প্রথমে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা বড় ধাক্কা হিসেবে দেখলেও, পরবর্তীতে সেই শুল্ক কমিয়ে আনা এবং ভারতের ওপর বাড়ানো শুল্ক পুরো পরিস্থিতির চিত্র বদলে দিয়েছে। আমেরিকা আরোপিত শুল্কের প্রভাবে চীন, ভারত ও মিয়ানমার থেকে অনেক পোশাক ক্রেতা এখন বাংলাদেশে কার্যাদেশ বাড়ানোর দিকে ঝুঁঁকছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ড্রোনাল্ড ট্রাম্প যখন বাংলাদেশের পোশাক পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন, তখন ব্যবসায়ীরা আশঙ্কিত ছিলেন। কারণ, ভারতের ও পাকিস্তানের জন্য প্রস্তাবিত হার ছিল কম। এর ফলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে বড় ধরনের আঘাত আসবে। তবে নাটকীয়ভাবে ১ আগস্ট শুল্ক আরোপের সময়সীমার কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনে। এর বিপরীতে ভারতের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি, ২৭ আগস্ট থেকে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা আসে রাশিয়ার তেল কেনার কারণে। এ পরিবর্তন পুরো চিত্রটাই বদলে দিয়েছে। এখন ভারতের পাশাপাশি চীন ও মিয়ানমার থেকেও যেসব ক্রেতারা পোশাক কিনে আসত, তারা এখন বাংলাদেশকে কার্যাদেশের জন্য প্রাথমিকভাবে পছন্দ করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন স্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারকরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে শুরু করেছেন। বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা কারখানা চালু করার পরিকল্পনা করছেন, পুরনো স্থগিত রাখা সম্প্র্রসারণ প্রকল্পগুলো পুনরুজ্জীবিত করছেন, এবং নতুন বিনিয়োগের কথাও ভাবছেন। স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ জানান, আমেরিকান বায়ারদের কাছ থেকে তাদের অর্ডার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। গত বছর এক মার্কিন বায়ারকে তিন লাখ পিস জ্যাকেট রফতানি করেছিলেন। এবার সেই অর্ডার বেড়ে পাঁচ লাখ পিসের কাছাকাছি আসছে। নতুন ক্রেতাদের সাথেও প্রাথমিক আলোচনা চলছে। তিনি বলেন, আমাদের কারখানার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নতুন মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিকল্পনা করছি অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, তাদের অর্ডার লাইনআপ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ণ। দুই মার্কিন ক্রেতার প্রতিনিধি সম্প্রতি আলোচনা করতে এসেছিলেন, কিন্তু কারখানায় জায়গার সঙ্কট থাকায় নতুন অর্ডার নিতে পারেননি।

একই সাথে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, বর্তমানে বিদেশী বায়াররা ফ্রি ক্যাপাসিটির (সক্ষমতা) কারখানা খুঁজছেন। তাই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে কারখানাগুলো বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নতুন ওয়াশিং প্ল্যান্ট নির্মাণ শুরু করেছি। চীন, ভারত ও মিয়ানমারের ওপর আমেরিকান শুল্ক বেশি হওয়ায় তাদের অর্ডার বাংলাদেশে আসবে। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার সক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে তারা দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে পারবে না।

চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে নতুন উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন। অনেকেই নতুন বিনিয়োগ এবং কারখানা ভাড়া নেয়ার মাধ্যমে উৎপাদন শুরু করতে আগ্রহী। এক নিটওয়্যার কারখানার মালিক জানান, তিনি ইতোমধ্যে একটি কারখানা চীনা উদ্যোক্তাদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন এবং তারা আরেকটি কারখানা ভাড়া নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

চীনা বায়িং হাউসগুলো ফ্রি অব চার্জ (এফওসি) মডেলে কাজ করার সুযোগ খুঁজছে, যেখানে বায়াররা কাঁচামাল সরবরাহ ও আর্থিক খরচ বহন করবে, আর কারখানা কর্তৃপক্ষ শুধু উৎপাদনের দায়িত্ব নেবে। এতে প্রস্তুতকারকের ঝুঁঁকি কমলেও লাভের হার কম। তবে ফকির ফ্যাশনসের মতো বড় কারখানা পর্যাপ্ত অর্ডার থাকায় এফওসি মডেল নিচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত দুই বছরে প্রায় ১৯১টি ছোট কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে নতুন করে প্রায় ১০০টি কারখানা উৎপাদন শুরু করেছে। বিজিএমইএ নেতারা বলছেন, বাজার পরিস্থিতি উন্নত হলে বন্ধ কারখানাগুলো পুনরায় চালু হতে পারে। বর্তমানে ফোর্সে অর্ডার ফিরে আসায় বন্ধ কারখানাগুলো পুনরুজ্জীবিত করা নিয়ে আলোচনা চলছে। গাজীপুরের টঙ্গীতে ৯ মাস আগে বন্ধ হওয়া ১০০ কর্মীর একটি সোয়েটার কারখানাও এখন পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে ইউরোপীয় বাজারে দাম কমে যাওয়ার আশঙ্কায় কিছু রফতানিকারক সতর্ক। কারণ, মার্কিন বাজার সঙ্কুুচিত হলে চীন ও ভারত তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ইউরোপের দিকে ঝুঁঁকবে। এতে দাম কমে যাবে এবং বাংলাদেশের জন্য চাপ সৃষ্টি হবে। জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক রাশেদ মোশাররফ বলেন, চীন ও ভারত যে ধরনের পণ্য তৈরি করছে সেগুলো বাংলাদেশের কারখানাগুলো তৈরিতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। তাই তারা দ্রুত সেই দিকটা ক্যাপচার করতে পারবে না। বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির অর্ধেকের বেশি পণ্য ইউরোপে যাচ্ছে, আর যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশেরও কম।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ফলে প্রথমে যেমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, পরে সেটি বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সুযোগে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীরা নতুন দিক থেকে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করছে, যা দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে ইউরোপীয় বাজারে প্রতিযোগিতার চাপকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন এক নবযুগের সন্ধিক্ষণে, যেখানে শুল্ক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগালে দেশের রফতানি আরো শক্তিশালী হতে পারে।