জুলাই সনদের সব বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্তের অঙ্গীকার করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। এর মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ কালক্ষেপণ না করে নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে। আর এই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় এমন আট অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
অঙ্গীকারগুলো হচ্ছে-
এক. জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগতিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাক্সক্ষা প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
দুই. এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ : তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে, এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করেছি বিধায় এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করব এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।
তিন. এই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যাসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নরে চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
চার. ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।
পাঁচ. ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা।
ছয়. গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত; ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া ।
সাত. রাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
এবং আট. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা।
জুলাই সনদের পটভূমি : জুলাই সনদের খসড়ার পটভূমিতে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং পূর্ব বাংলা তার অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরশাসন, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি। কারণ, শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক দিকে যেমন টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, অপর দিকে তেমনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামমাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত ন্যুব্জ ও দুর্বলভাবে কাজ করেছে। বস্তুতপক্ষে, রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
পটভূমিতে বলা হয়, বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে অবশিষ্ট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা, হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাস ও ভীতির রাজত্ব কায়েম করে। ২০০৯ সালের পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড অন্যতম উদাহরণ। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে। এই পটভূমিকায় রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এক দফা আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-শ্রমিক-নারী-পেশাজীবী তথা সব স্তরের জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চার শ’র বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং বিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায়, জনগণের মননে রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের এক প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রসংস্কার, বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, ধসে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইন ও বিধি-বিধানের সংস্কার, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তার সদ্ব্যবহার করা সবার নৈতিক দায়িত্ব।