কিডনি-লিভার ধ্বংসকারী ও ক্যান্সার সৃষ্টির ঘনচিনি বেনামে ঢুকছে দেশে

চট্টগ্রামে বিশাল চালান আটক

Printed Edition

নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো

আবারো চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ ঘনচিনির (সোডিয়াম সাইক্লামেট) চালান আটক করেছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। সোডা অ্যাশ ঘোষণায় আনা তিনটি কনটেইনারে মিলেছে ৬০ হাজার ৪৮০ কেজি মানুষের জীবননাশী ঘনচিনি। ইতঃপূর্বে ২০২২ সালের মে মাসেও চট্টগ্রাম বন্দরে আটক করা হয়েছিল ১৯ টন ঘনচিনির বড় একটি চালান। সেই চালানও এসেছিল সোডা অ্যাশের ঘোষণায়।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপকমিশনার (এআই্আর) মো: তারেক মাহমুদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঘনচিনি আমদানি নিষিদ্ধ। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শিল্প কারখানার জন্য আমদানি করা যায়। তবে তা খুবই নিয়ন্ত্রিত। সোডা অ্যাশ বেভারেজ জাতীয় ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হয় এবং দেখতে অনেকটা ঘনচিনির কাছাকাছি। হয়তো সেই সুযোগটাই নেয়ার চেষ্টা করে অসাধু আমদানিকারকরা।

এই শুল্ক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে তিনটি কনটেইনারে আমদানীকৃত ৬০ হাজার ৪৮০ কেজি ঘনচিনি (সোডিয়াম সাইক্লামেট) আটক করা হয়েছে। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল, ঢাকা এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের সহযোগিতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ আটক সম্পন্ন হয়েছে বলে তিনি জানান। আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪ এর বিধান মোতাবেক নিষিদ্ধ ঘনচিনি আমদানি করায় কাস্টমস আইন, ২০২৩ এর বিধান মোতাবেক পণ্যচালানটি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ কর্তৃক আটক করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। তিনি জানান, পণ্যচালানটির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা এবং ঘনচিনির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শুল্ক-করহার ৬১.৮০ শতাংশ। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশ কাস্টমসের যে অঙ্গীকার তার যথার্থ প্রতিফলন আমদানি নিষিদ্ধ ঘনচিনির এই চালানটি আটক হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আটককৃত ঘনচিনির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মতিঝিল জীবন বীমা ভবনের এইচ পি ইন্টারন্যাশনাল। সোডা অ্যাশ লাইট ঘোষণায় চীন থেকে গত ১৬ আগস্ট ওই কনটেইনার তিনটি চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা হয় এবং তা খালাসের জন্য গোল্ডেন কনটেইনার লিমিটেড নামীয় বেসরকারি আইসিডিতে নেয়া হয়। পরবর্তীকালে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ কর্তৃক ওই কনটেইনারগুলোর খালাস স্থগিত করা হয় এবং গত ১৬ সেপ্টেম্বর কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, ডিপো কর্তৃপক্ষ, সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। কায়িক পরীক্ষায় প্রাপ্ত পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানোপ্রযুক্তি সেন্টার, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাব এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ ল্যাবে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়। তিনটি ল্যাব হতেই রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে ওই পণ্যকে ঘনচিনি (সোডিয়াম সাইক্লামেট) হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে।

ঘনচিনি একটি কৃত্রিম মিষ্টিকারক যা সাধারণ চিনির চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, বেকারি আইটেম, আইসক্রিম, বেভারেজ, জুস, চকোলেট, কনডেন্সড মিল্ক এবং শিশুখাদ্য তৈরিতে সাধারণ চিনির পরিবর্তে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই ক্ষতিকারক কৃত্রিম উপাদানটি ব্যবহার করে থাকে। ঘনচিনি দিয়ে তৈরি খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ঘনচিনির দ্বারা প্রস্তুতকৃত খাদ্য ক্যান্সারসহ কিডনি ও লিভারের জটিল রোগের কারণ হতে পারে। ঘনচিনির অপব্যবহার রোধকল্পে সরকার পণ্যটিকে আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪ এর আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ঘনচিনি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এমনিতেই ঘনচিনি প্রাণঘাতী। এর উপর অসাধু ব্যবসায়ীরা ঘনচিনির সাথে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট নামীয় রাসায়নিক সার মিশিয়ে প্যাকেটজাত করে সস্তায় বিক্রি করে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি বিভাগ কর্তৃক ২০১৯ সালে করা এক গবেষণা জরিপে বাজার থেকে ব্র্যান্ড-নন ব্র্যান্ড সাদা চিনির নমুনা সংগ্রহ করে সিঙ্গাপুরে পাঠায় সোডিয়াম সাইক্লামেটের উপস্থিতি নির্ধারণের জন্য। রিপোর্টে সব নমুনায় অল্প পরিমাণে ঘনচিনির উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। অথচ কোন মাত্রায় ঘনচিনির অস্তিত্ব থাকার সুযোগ নেই।

এ দিকে ঘনচিনির বিশাল চালান আটকের ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে ভিন্ন নামে প্রতিনিয়তই কি প্রাণঘাতী এই পণ্য আমাদের দেশে ঢুকছে? জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বন্দরকেন্দ্রিক কঠোর নজারদারির তাগিদ দিয়েছেন সচেতন মহল।