আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। নতুন এই সিদ্ধান্ত এশিয়ার এই স্বল্পোন্নত দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি খাতকে কঠিন সঙ্কটে ফেলতে পারে। ট্রাম্পের এই আরোপিত শুল্ক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং বৈশ্বিকভাবে মার্কিন ট্যারিফের মধ্যে ১৫তম সর্বোচ্চ। এমন পরিস্থিতিতে দেশের পোশাক শিল্প বেশ বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে তারা মনে করছেন, আমেরিকার নতুন শুল্কনীতির কারণে বড় ধরনের সুবিধা পাবে ভারতের পোশাক শিল্প। তারা বলছেন, পোশাক রফতানিতে উদীয়মান নেতৃস্থানীয় ভারত ও পাকিস্তানের রয়েছে ব্যাপক তুলা উৎপাদন সক্ষমতা। তাদের জন্য শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে যথাক্রমে ২৬ ও ২৯ শতাংশ। এই পার্থক্যের কারণেই তারা বাংলাদেশের বিপরীতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ১০ শতাংশের মতো প্রতিযোগী সুবিধা পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শুল্কনীতির কারণে হিসাবনিকাশের সমীকরণও দিচ্ছে এক আশঙ্কাজনক চিত্র। আগে আমেরিকার বাজারে ১৬ শতাংশ শুল্কের অধীনে বাংলাদেশে তৈরি একটি শার্ট যখন দেশটির বাজারে প্রবেশ করত তখন ১০ ডলারের ভিত্তিমূল্য থেকে শুল্ক যোগ হয়ে দাম হতো ১১ দশমিক ৬০ ডলার। কিন্তু, এখন অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্কের কারণে দাম পড়বে ১৫ ডলার। দাম এতটা বাড়ার ফলে মার্কিন ভোক্তারা বাংলাদেশের তৈরি পণ্য কেনার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হতে পারে। তখন তারা বাংলাদেশী পণ্য বাদ দিয়ে এর চেয়ে কম দামের পণ্য খুঁজবেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপের জেরে বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের রফতানিতে পড়তে পারে। তবে মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলেও উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন শুল্ক আরোপের ফলে আমেরিকার বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ বাংলাদেশের প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের ওপরেও একই ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, আমেরিকা তাদের পণ্য বাংলাদেশে রফতানিতে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয় বলে যে হিসাব প্রকাশ করেছে, সেটি কিভাবে হিসাব করেছে এই বিষয়টি জানতে চাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রফতানির পঞ্চম বৃহত্তম বাজার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই তুলা রফতানিতে বাংলাদেশের কোনো শুল্ক নেই। বাংলাদেশ স্ক্র্যাপ আমদানি করে আমেরিকা থেকে। সেখানেও শূন্য শুল্ক। পেট্রোলিয়াম গ্যাস আমদানিতে ৩১ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এই হচ্ছে প্রধান প্রধান আমদানি। তাহলে আমেরিকা কেন ৭৪ শতাংশের কথা বলছে, সেটা জানতে চাওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ এতে মার্কিন বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান, শুল্ক বাড়ানোর ফলে সামগ্রিকভাবে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে রফতানি কমার ঝুঁকি রয়েছে তিনি মনে করেন।
এ দিকে দক্ষিণ এশীয় নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি বিশ্ব বাণিজ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক যুদ্ধ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দীর্ঘ দিনের সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের (এমএফএন) নীতির বিপরীতে এক নতুন প্রবণতা সৃষ্টি করছে।
আমেরিকার নতুন মার্কিন শুল্কের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্প নেতারা। তারা একে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যা বাণিজ্য ব্যাহত করতে পারে এবং মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, শুল্ক হার ৩৭ শতাংশ বাড়ানো মানে এটি অতিরিক্ত শুল্ক। এর ফলে তুলা-মিশ্রিত তৈরি পোশাকে মোট শুল্ক ৫৪ শতাংশে (৩৭ শতাংশ + ১৭ শতাংশ) পৌঁছবে। তিনি বলেন বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ শুল্কের শিকার দেশগুলোর একটি। এ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের শুল্কহার চীনের তুলা পণ্যের সমপর্যায়ে পৌঁছবে। ভারতসহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোকেও শুল্ক বৃদ্ধির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হার ভারতের চেয়ে আরো বেশি, যা ক্রেতাদের জন্য বাংলাদেশের বাজারকে কম আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে বলে শোভন ইসলাম মনে করেন।
দেশের পোশাক খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপ। ২০২৪ সালে প্রষ্ঠানটি ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার নয়া দিগন্তকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অ্যাক্সেস পেতে আমরা এখন ১৫-১৬ শতাংশ ট্যারিফ দিচ্ছি। এরমধ্যে ৩৭ শতাংশ ট্যাক্স বৃদ্ধি কার্যকর হলে বড় একটা আঘাত হয়ে আসবে।
শাশা ডেনিমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, চীন থেকে শিল্প খাতের প্রত্যাশিত স্থানান্তর, যা একসময় বাংলাদেশের জন্য প্রবৃদ্ধির একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছিল, তা এখন মারাত্মক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়াও এই পরিস্থিতিতে হোঁচট খেতে পারে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাংলাদেশের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি আমদানির চেয়ে অনেক বেশি। রফতানি তৈরি পোশাকের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, যার মধ্যে বেশির ভাগ মৌলিক আইটেম। অন্য দিকে বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি লোহা, ইস্পাত, খনিজ জ্বালানি, তুলা, তেলবীজ ও নিউক্লিয়ার রেক্টরসহ পাঁচটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার এবং দেশ থেকে আমদানি ছিল ২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬০১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার মূল্যের লোহার ইস্পাত আমদানি করেছে। এরপরে খনিজ জ্বালানি ৫৯৫ দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার, তুলা ৩৬১ মিলিয়ন ডলার, তেলবীজ ৩৪১ মিলিয়ন ডলার ও নিউক্লিয়ার রেক্টর আমদানি করেছে ১১১ মিলিয়ন ডলারের।
বাংলাদেশের রফতানি আয় বেশির ভাগ আসে তৈরি পোশাক থেকে। ২০২৪-২৪ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের ৭ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। বাকিটা এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, চামড়ার জুতা, ফার্মাসিউটিক্যালস ও বিভিন্ন কৃষিপণ্য থেকে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ছিল ৯৭০১ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, আমদানি ২৩৪৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২১- ২২ অর্থবছরে রফতানি ১০৪১৭ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ২৮২৫ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ ২১ অর্থবছরে রফতানি ৬৯৭৪ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ২২৬৮ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি ছিল ৫৮৩২ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ২১২৬ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি ছিল ৬৮৭৬ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ১৭৭৩ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি ছিল ৫৯৮৩ দশমিক ৩১ মিলিয়ন ডলার, আমদানি ১৭০৪ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।