সাক্ষাৎকার : আবু সাঈদ রিয়াজ

প্রবাসী কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়াবে

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
আবু সাঈদ রিয়াজ
আবু সাঈদ রিয়াজ

প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোতে অবিলম্বে ২৪ ঘণ্টা জরুরি হটলাইন ও হেল্প ডেস্ক চালুর দাবি দীর্ঘ দিনের। কিন্তু তা আজও হয়নি। যতই বলা হোক দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে রেমিট্যান্স কিন্তু কিছু পদক্ষেপ নিলে এই রেমিট্যান্স প্রবাহ যে আরো দ্রুত কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব তা নিয়ে কার্যকর কোনো কিছু দেখা যায় না। এমন আক্ষেপ জানালেন ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগ বিশ্লেষক আবু সাঈদ রিয়াজ। ৩৫ বছর ইতালিতে প্রবাস জীবনের পর গত সাত বছর ধরে ব্রিটেনে রয়েছেন তিনি। দিন কয়েকের জন্য দেশে এসেছেন। ইতোমধ্যে প্রবাসীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। কিন্তু তিনি অনেকটা হতাশ কারণ দীর্ঘ দিন ধরেই তারা এসব কথা বলে আসছেন, জটিলতা রয়ে যাচ্ছে, কার্যত যতটা সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না।

নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবু সাঈদ রিয়াজ এসব কথা বলেন।

নয়া দিগন্ত : প্রবাসীদের জন্যে কেনো ২৪ ঘণ্টার হটলাইন ও হেল্প ডেস্ক প্রয়োজন?

আবু সাঈদ রিয়াজ : মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যে লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকে প্রায়ই বিড়ম্বনার মুখে পড়েন তাদের পাসপোর্ট, ভিসা বা বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ইতালি, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে অফিস আওয়ারের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। প্রবাসী ভাইদের অনেকে ঠিকমতো বিভিন্ন দেশের নিয়ম বুঝে উঠতে পারেন না। তাদের ভালো সার্ভিস দিতে গেলে অনলাইন সেবা প্রয়োজন। ইতালিতে তিন লাখ প্রবাসীর এ ধরনের চাহিদা দুটো অফিস জোগান দিতে হিমশিম খায়। দীর্ঘ লাইনে থাকার পর আবার অন্যদিন যেতে হয় অফিস সময় শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। হেল্প ডেস্ক থাকলে দশজন লোক নিয়োগের প্রয়োজন নেই। প্রবাসীদের সাথে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোর একটা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারে। একই সাথে দেশে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের ডেস্ক স্থাপন করলে প্রবাসীদের স্বজনরা সেখান থেকে বিভিন্ন তথ্য পেয়ে উপকৃত হতে পারেন বা জরুরি তথ্য জানাতে পারেন। এতে সরকারও প্রবাসীদের সমস্যা নিরসনে ভালো ফিডব্যাক পাবে।

নয়া দিগন্ত : প্রবাসীদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ বছর ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা চাচ্ছেন কেন?

আবু সাঈদ রিয়াজ : প্রবাসীরা যখন দেশে বিনিয়োগ করে, শিল্প স্থাপন করেন, সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন, এসব বিনিয়োগে করমুক্ত সুবিধা দিলে বিনিয়োগ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

নয়া দিগন্ত : বিদেশে প্রবাসীর মৃত্যু হলে সরকারি খরচে লাশ আনার দাবি করছেন...

আবু সাঈদ রিয়াজ : গত বছর চার হাজার ৮১৩ জন প্রবাসীর লাশ দেশে এসেছে। প্রতি মাসে গড়ে ৪০০টি লাশ আসে, যা প্রতিদিন প্রায় ১৩টি। এদের ৬৭ শতাংশের বেশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত ছিল। চলতি মাসেই ইতালিতে ১০ দিনে তিনজন প্রবাসী বাংলাদেশী মারা গেছেন। ইতালি থেকে একজন প্রবাসীর লাশ দেশে আনতে চার হাজার ইউরো খরচ হয়। এ খরচ তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বেশির ভাগ সময় ব্যয় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। হাসিনার শাসনামলে বছর খানেক সরকার এ খরচ বহন করলেও তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এটা আবার চালুর দাবি জানাচ্ছি। এরপর লাশ ঢাকায় বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলেও তা ছাড় করাতে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। মৃত প্রবাসীর স্বজনদের দিনের পর দিন ঘুরতে হয়।

নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোতে দলীয়মুক্ত পরিবেশের কথা বলছেন, এটি কি ধরনের সমস্যা তৈরি করে?

আবু সাঈদ রিয়াজ : যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তখন বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোতে এক ধরনের দালাল শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রবাসী নেতাদের কাছে ধরনা দিতে হয় বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্যে। যারা একটু পড়াশোনা কম করেছেন, বুঝে উঠতে পারেন না সেবা কিভাবে পাবেন বা জটিলতা কিভাবে দূর করবেন, এমন প্রবাসীরা দূতাবাসগুলোতে গেলে তারা দালালদের খপ্পড়ে পড়ে যান। অন্তত ২০ শতাংশ প্রবাসী এমন ধরনের নাজেহালের শিকার হন।

নয়া দিগন্ত : জেলা পর্যায়ে প্রবাসী সেবা কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন কেন?

আবু সাঈদ রিয়াজ : এ ধরনের সেবাকেন্দ্র থাকলে সরকারের হাতে একটা সুনির্দিষ্ট তালিকা থাকবে কোন দেশে কতজন প্রবাসী রয়েছে। প্রবাসীরা সহজেই স্বজনদের খোঁজ খবর এ ধরনের সেবাকেন্দ্র থেকে নিতে পারবেন। সরকারের কোনো তথ্য প্রবাসীদের কাছে সহজেই দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে। প্রবাসীদের স্বজনরা অনেক সময় ব্যাংকে গিয়ে বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা তুলতে নানা জটিলতায় পড়েন, সে সম্পর্কে এ ধরনের সেবা কেন্দ্র সাহায্য করতে পারবে।

নয়া দিগন্ত : রেমিট্যান্সে সরকারি ইনসেন্টিভ বাড়াতে বলছেন

আবু সাঈদ রিয়াজ : সরকার এখন এ ধরনের ইনসেন্টিভ আড়াই শতাংশ দিচ্ছেন। এটা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করলে ও প্রণোদনা দিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বৃদ্ধি পাবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের অর্থনীতি একেবারে নিচে নেমে গিয়েছিল। রেমিট্যান্সই তা বাঁচিয়েছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পেছনে রেমিট্যান্সই মূল চালিকা শক্তি। গত অর্থবছরে রেকর্ড ভাঙা ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসায় দেশের আমদানি দায় পরিশোধের প্রায় ৪৫ শতাংশ মেটানো সম্ভব হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তো সেই তুলনায় প্রবাসীদের প্রণোদনা দিলে রেমিট্যান্স আরো বেগবান হবে।

নয়া দিগন্ত : আপনারা প্রবাসীদের সন্তানদের শিক্ষায় আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার কথা বলেছেন, এটি কিভাবে সম্ভব?

আবু সাঈদ রিয়াজ : এ জন্যই আমরা প্রবাসী সেবাকেন্দ্র স্থাপনের কথা বলছি। এ ধরনের কেন্দ্র থেকে প্রবাসীদের ছেলেমেয়েদের ভালো ফলাফলের জন্য বিশেষ বৃত্তি দেয়া যেতে পারে। কারণ পরিবার ছাড়া প্রবাসীরা বিদেশে কর্মরত থাকার সময় তাদের সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। ভালো ফলাফলের জন্য সরকার যদি তাদের ছেলেমেয়েকে আর্থিক সহায়তা দেয় তাহলে প্রবাসীরা ভরসা পাবেন এবং এর বেনিফিট সরকারই পাবে।

নয়া দিগন্ত : বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্যে পৃথক দ্রুতগতির ইমিগ্রেশন কাউন্টার চেয়েছেন...

আবু সাঈদ রিয়াজ : এখনো বিমানবন্দরে প্রবাসীদের অনেকে নাজেহালের শিকার হন। তাদের কেউ কেউ অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। আমরা আসলে বিমানবন্দরে হ্রাসকৃত মূল্যে চা খাওয়ার সুযোগ চাইনি। প্রয়োজনীয় ও কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করতে হবে। একটা ফর্ম পূরণ করে শেষ সম্বল ৫০ ডলারের ১০ ডলার অনেক সময় ছিনিয়ে নেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে ক্যামেরা সার্ভিলেন্স থাকা দরকার এবং ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

নয়া দিগন্ত : প্রবাসীদের সম্পত্তি রক্ষায় একটি বিশেষ পুলিশ গঠনের কথা বলেছেন...

আবু সাঈদ রিয়াজ : প্রতিটি থানায় এ ধরনের স্বতন্ত্র পুলিশ ইউনিট থাকলে প্রবাসীদের অনুপস্থিতিতে তাদের জমি বা অন্যান্য সম্পদ অনেকসময় বেদখল হয়ে যায় যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এ ধরনের ইউনিটের সাথে প্রবাসীরা যোগাযোগ করে তাদের সম্পদ দেখভালের সুযোগ পাবেন। দেখেন একজন প্রবাসী তার সর্বস্ব খরচ করে জীবনের একটা সোনালী অধ্যায় বিদেশে ব্যয় করে আসেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি যদি প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পেতেন তাহলে তার পক্ষে বাকি জীবন কিছু একটা করে খাওয়ার সুযোগ থাকত। প্রয়োজনে সরকারি পেনশন স্কিমে তাদের অন্তর্ভুক্তি করা যায়। সরকার যদি প্রবাসীর জীবন মান উন্নত করতে এসব উদ্যোগ নেন তাহলে তারা দেশের অর্থনীতিকে আরো বেশি উপকৃত করতে সচেষ্ট হবেন। প্রবাসীরা শুধু পরিবারের ভরণ-পোষণ করেন না, তারা দেশের সমৃদ্ধি, বিনিয়োগ, সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সমৃদ্ধি করছে। তার পরেও প্রবাসীরা যখন সমস্যায় পড়েন- পাসপোর্ট, কাগজপত্র, মৃত্যুবরণ, সম্পত্তি রক্ষা-প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা থেকে প্রায়ই বঞ্চিত হন। অথচ এগুলো প্রবাসীর ন্যায্য অধিকার। তাদের অধিকার নিশ্চিত করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে।

নয়া দিগন্ত : প্রবাসীদের দীর্ঘ দিনের দাবি ভোটাধিকার, সম্ভবত এবার তা পেতে যাচ্ছেন...

আবু সাঈদ রিয়াজ : এখানেও বেশ কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা যত সহজে ভোট দিতে পারেন, ন্যাশনাল আইডি বা পাসপোর্ট দেখিয়ে, বাংলাদেশী প্রবাসীদের ক্ষেত্রে অন্তত ১১টি তথ্য নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে যা পূরণ করা অনেক ক্ষেত্রে জটিল হয়ে পড়ছে। অন্তত এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে এখনো নিশ্চিত নয়।