সেচের আওতায় আসবে ১৮৯২০ হেক্টর জমি খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়বে ৯৪৬০০ টন

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ প্রকল্প

এস এম রহমান, পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম)
Printed Edition
সেচের আওতায় আসবে ১৮৯২০ হেক্টর জমি খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়বে ৯৪৬০০ টন
সেচের আওতায় আসবে ১৮৯২০ হেক্টর জমি খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়বে ৯৪৬০০ টন

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) গৃহীত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প কাজের অগ্রগতি ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ওই দুই জেলায় নতুনভাবে সেচের আওতায় আসবে ১৮ হাজার ৯২০ হেক্টর অনাবাদি জমি। এতে দুই জেলায় প্রতি বছর ধান শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে ৯৪ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৬০২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। গতকাল যোগাযোগ করা হলে এই প্রকল্পের পিডি মো: নুরুল ইসলাম কাজের অগ্রগতির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করছেন তিনি।

জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫২৫ কিলোমিটার সেচ ও নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন করা হচ্ছে। পুনঃখননকৃত খালে সেচের পানি সংরক্ষণ করার পাশাপশি খাল পুনঃখননের ফলে জলাবদ্ধতা দূর হবে। ফলে এক দুই ফসলি জমি দুই তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর হবে। এতে খালে ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া পুনঃখননকৃত খাল ও নদীতে ২৩৫টি বিদ্যুৎচালিত এলএলপি স্থাপন করা হবে। ফলে ১৮ হাজার ৯২০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে এবং ৯৪ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি শস্যদানা উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। যার বর্তমান বাজার মূল্য হবে ১৮ হাজার ৯২০ লাখ টাকা।

প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো: নুরুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই দুই জেলায় সেচ অবকাঠামো নির্মাণ ও আধুনিক সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানিনির্ভর সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা। তিনি জানান, প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে জুলাই ’২৩ থেকে আর বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ৩০ জুন ২০২৮ পর্যন্ত। আর চট্টগ্রামের পটিয়া-চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, মিরসরাই, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, সন্দ্বীপ, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড এবং কক্সবাজারের সব ক’টি উপজেলায় একই সাথে এ প্রকল্প বাস্তায়নের কাজ চলছে। মূলত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে খাল পুনঃখনন ও সেচযন্ত্র সরবরাহ, আর্টেসিয়ান ও ডাগওয়েল স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় সেচ অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে ৭৩ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে ভূ-উপরিস্থ পানিনির্ভর সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করে প্রতি বছর চার লাখ পাঁচ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন ও পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ত্বরান্বিত করাই মূল উদ্দেশ্য।

সরেজমিন দেখা গেছে, এ প্রকল্পের দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন উপজেলায় খাল পুনঃখননকাজ চলমান থাকায় এবার কয়েক দফা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল নদী ও খালের বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও যথাসময়ে তা নিষ্কাশন হয়। এতে জেলায় ফসল অনেকাংশই নিরাপদ ছিল বলে জানিয়েছে কৃষকরা।

প্রকল্পের প্রতিবেদনে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। দিন দিন এই জনসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ গ্রামে বাস করে এবং তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট ভূমির পরিমাণ নির্দিষ্ট হলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার বসতভিটা তৈরি ও বিভিন্ন উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতি বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষি জমির পরিমাণ মোট ভূমির ৭০.২ শতাংশ। মাথাপিছু কৃষি জমির পরিমাণ ১২.৫ শতক, প্রতি বছর ০.৫৬ শতাংশ হারে কৃষি জমি অকৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে তাতে ০.৮৬-১.১৬ শতাংশ ধান উৎপাদন কমছে। এই হারে জমি হ্রাস পেতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে কৃষি জমির পরিমাণ আরো ১৫ শতাংশ কমে যাবে। জমির পরিমাণ কমে এলে স্বাভাবিকভাবে ফসল উৎপাদনও হ্রাস পাবে। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির প্রভাব তো আছেই। এমতাবস্থায়, দেশের এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান ফসল ধান যা সেচ ছাড়া চাষ করা অসম্ভব। অন্যান্য ফল ও সবজি উৎপাদনের জন্যও সেচ অপরিহার্য। এ দিকে উচ্চফলনশীল জাতের ফসল আবাদের পূর্বশর্ত হলো সেচ। সেচের পানি ছাড়া আশানুরূপ ফলন ফলানো একেবারেই অসম্ভব। সে কারণে দেশে একটি আধুনিক এবং টেকসই সেচ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।

প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার মোট আয়তন সাত লাখথ ৭৭ হাজার ৪৮০ হেক্টর এবং মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দুই লাখ ৬৫ হাজার ৬০১ হেক্টর হলেও এ দুই জেলায় মোট সেচকৃত জমি মাত্র এক লাখ ২৯ হাজার ৬১৫ হেক্টর যা মোট চাষযোগ্য জমির ৪৮.৮০ ভাগ অর্থাৎ এখনো প্রায় অর্ধেকের বেশি চাষযোগ্য জমি সেচের আওতাবহির্ভূত রয়েছে। এ বিশাল পরিমাণ জমি পতিত ও সেচের বাইরে রেখে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার বিপুল জমি চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক ও টেকসই সেচ আবাদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পিডি মো: নুরুল ইসলাম।