বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও বেশির ভাগ সূচকে তারা প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। তবে এজেন্ট ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ধারায় ইসলামী ব্যাংকগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে। অন্য দিকে, আমানত, সম্পদ, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স খাতে প্রচলিত ব্যাংকগুলো এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ চিত্র ফুটে ওঠেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিগত সরকারের আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী ব্যাংকগুলোর মালিকানা দখল করে ইচ্ছামতো এর তহবিল ব্যবহারে ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোকে এখন সর্বাগ্রে গভর্নেন্স সংস্কার, ডিজিটাল ইনোভেশন ও গ্রাহক আস্থার পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে, অন্যথায় মূলধন বাজারে তাদের অংশীদারিত্ব আরো কমে যেতে পারে।
আমানত প্রবৃদ্ধি : প্রচলিত ব্যাংকের আস্থা পুনরুদ্ধার : ২০২৪ সালের আগস্টে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৮.৪৮ ট্রিলিয়ন টাকা, যা এক বছর পর বেড়ে ২০.৫১ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছেছে, বৃদ্ধি প্রায় ১১শতাংশ। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং খাতের আমানত বেড়েছে ৭.০৬ শতাংশ, ৪.৩২ ট্রিলিয়ন থেকে ৪.৬২ ট্রিলিয়ন টাকায়। অপর দিকে, প্রচলিত ব্যাংকগুলো ১২.১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ১৪.১৬ ট্রিলিয়ন থেকে ১৫.৮৯ ট্রিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনের পর কিছু ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে আমানতকারীদের আস্থা কিছুটা কমে যায়। ফলে বাজারে ইসলামী ব্যাংকের আমানত অংশীদারিত্ব ২৩.৩৬শতাংশ থেকে নেমে ২২.৫৪ শতাংশে এসেছে।
বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি : স্থিতিশীল কিন্তু পিছিয়ে : ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে ১১.৩৮ শতাংশ, অর্থাৎ ২০.৭২ ট্রিলিয়ন থেকে ২৩.০৮ ট্রিলিয়ন টাকায়। ইসলামী ব্যাংকিং বিনিয়োগ বেড়েছে ১০.৫৫ শতাংশ, ৫.১৭ ট্রিলিয়ন থেকে ৫.৭২ ট্রিলিয়ন টাকায়। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বেড়েছে ১১.৬৬ শতাংশ এবং তারা বর্তমানে মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
সম্পদ : প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ব্যবধান বাড়ছে : ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ ৮.৪১ ট্রিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯.৪৩ ট্রিলিয়ন টাকায় দাঁড়িয়েছে, বৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ। অন্য দিকে প্রচলিত ব্যাংকের সম্পদ বেড়েছে ১৬.৪২ শতাংশ, ৩০.৮৮ ট্রিলিয়ন থেকে ৩৫.৯৫ ট্রিলিয়ন টাকায়। এই প্রবণতা ইঙ্গিত দেয় যে, মূলধন ও সম্পদে প্রচলিত ব্যাংকের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে।
রফতানি আয়ে পিছিয়ে ইসলামী ব্যাংক : ২০২৫ সালের আগস্টে ইসলামী ব্যাংকগুলো রফতানি আয় পেয়েছে ৭৭৫ মিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৬৯০ মিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২.৩২ শতাংশ। একই সময়ে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর রফতানি আয় বেড়েছে ১৭.৭২ শতাংশ, ২৫৬৮ মিলিয়ন থেকে ৩০২৩ মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ দেশের মোট রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশ এখনো প্রচলিত ব্যাংকের মাধ্যমে আসে।
আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য : ২০২৫ সালের আগস্টে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি পরিশোধ কমে দাঁড়িয়েছে ০.৮৯ বিলিয়ন ডলারে, যা এক বছর আগে ছিল ১.১৩ বিলিয়ন ডলার হ্রাস প্রায় ২১ শতাংশ। অন্য দিকে প্রচলিত ব্যাংকগুলো মাসভিত্তিকভাবে ৩.৬-৪.৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যদিও কিছু সময় ডলার সঙ্কটের কারণে ওঠানামা ছিল।
রেমিট্যান্সে আস্থাহীনতা : ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে ইসলামী ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে, বিপরীতে প্রচলিত ব্যাংকগুলো স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স নেমেছে ৭৬৪ মিলিয়ন থেকে ৬১০ মিলিয়ন ডলারে, অন্য দিকে প্রচলিত ব্যাংকের প্রবাহ বেড়েছে ১১৬৬ মিলিয়ন থেকে ১৮১২ মিলিয়ন ডলারে। এতে ইসলামী ব্যাংকের বাজার অংশীদারিত্ব সামান্য বেড়ে ২৫.১৯ শতাংশ, কিন্তু প্রকৃত অর্থপ্রবাহ হ্রাস পেয়েছে।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে ইসলামী ব্যাংকের উত্থান : সবচেয়ে ইতিবাচক চিত্র দেখা গেছে এজেন্ট ব্যাংকিং খাতে। ২০২৪ সালের আগস্টে ইসলামী ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং আমানতের ৫৩.৬৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল, যা ২০২৫ সালের আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশ এর কাছাকাছি।
অর্থমূল্যে এটি বেড়েছে ২০৫ বিলিয়ন থেকে ২৬০ বিলিয়ন টাকায়, প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ, যেখানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর বৃদ্ধি ছিল ১৮.৬১ শতাংশ। এটি নির্দেশ করে, ইসলামী ব্যাংকিং খাতে গ্রামীণ আস্থা ও ডিজিটাল সেবার ব্যবহার বেড়েছে। সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে-ইসলামী ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল হলেও প্রবৃদ্ধি সীমিত। প্রচলিত ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ ও মূলধনে আধিপত্য বজায় রেখেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং ও বিকল্প সেবায় ইসলামী ব্যাংকগুলো আশাব্যঞ্জক ভূমিকা রাখছে।



