বিশিষ্ট আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী বলেছেন, স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনগুলো আগে না হলে মব তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সংসদ নির্বাচন আগে হলে বাংলাদেশকে ৩০০ টুকরায় বিভক্ত করেও মব তৈরি হতে পারে এবং স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে না। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবু হেনা রাজ্জাকী নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, অতীত সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মব ঘটেছে। তা সাংবিধানিক মব বলেন আর অর্থনৈতিক মব বলেন। রাষ্ট্রীয় লেভেল থেকে মব যাতে না হয় সেজন্যে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। মব নিয়ন্ত্রণের রাস্তাটাই হলো ট্রান্সপারেন্সি। প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বপর্যায়ে স্বচ্ছতা সৃষ্টি করতে না পারলে মব নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
নয়া দিগন্ত : সংসদীয় নির্বাচন আগে হলে মব’এর আশঙ্কা করছেন কেন?
আবু হেনা রাজ্জাকী : আপনি ইউনিয়ন বা উপজেলা নির্বাচন আগে চান না। সংসদ নির্বাচন আগে হলে যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন তার পছন্দের বাইরে কেউ উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারবে না। তারাই ত্রিরতœ হয়ে একটা মব তৈরি করতে পারে এমন শঙ্কা থেকে যায় স্থানীয় সরকার প্রশাসনে। সংসদ সদস্যের বাইরে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এই যে তাদের বাইরে কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সিদ্ধান্ত হয় না সেটাই মব। প্রশাসন নিশ্চুপ বসে থাকে। অতীত সরকারের আমলে তাই দেখা গেছে। তারা সংসদ নির্বাচন করে বাংলাদেশকে ৩০০ টুকরো করে ৩০০ এমপি মবের বস হয়ে বসতেন। মব লালন করার জন্যেই আগে সংসদ নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। মব জাস্টিস মানবতাবিরোধী সেটা অন্ধ লোকও বলবে। ইলেক্টোরাল কলেজের কথা বলা হচ্ছে তো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য রাফলি ৭০ হাজার হয় জনপ্রতিনিধির সংখ্যা। এই ৭০ হাজার মানুষ যদি ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি বানায় তাহলে সংসদীয় পদ্ধতিতে যেভাবে রাষ্ট্রপতি বানায় সেভাবে বানানো সম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী এক দলের আর রাষ্ট্রপতি আরেক দলের হলে ক্ষমতার ভারসাম্য কাজে লাগতে পারে। কিন্তু একই দলের থেকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আবার রাষ্ট্রপতি তাতে দুজনে ক্ষমতা ভাগ করলে কিছু হবে না। ৭০ হাজার লোকের ভোট দিয়ে আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে চাইলে স্থানীয় নির্বাচন আগে করতে হবে। তা না হলে ইলেক্টোরাল প্রতিনিধি পাবেন কোথায়? আগে সংসদ নির্বাচন করলে ইউপি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্যে কি বসে থাকা সম্ভব? রাষ্ট্রপতিশূন্য তো দেশ থাকতে পারে না।
নয়া দিগন্ত : আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন ফর্মে মব ঘটেছে আপনি বলছেন?
আবু হেনা রাজ্জাকী : আপনি যদি বিগত সরকারের আমলের দিকে তাকান, মব কাকে বলে, সাংবিধানিক মব আমার বিবেচনায় তা আছে। আছে অর্থনৈতিক মব, রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক মব আছে, সেটা কি রকম, যেমন ধরুন কয়দিন আগে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা, তাকে ধরে গলায় জুতার মালা দিয়েছে, এবং এটাকে অনেকে বলছেন মব হয়েছে। আমি নৈতিকভাবে তার গায়ে হাত দেয়া সমর্থন করি না, জুতার মালা দেয়া, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে বা একজন আইনজীবী হিসেবে কখনোই এটি সমর্থন করি না। কিন্তু সে যখন সাংবিধানিক পাওয়ারটা হোল্ড করছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে, উনি কি জানতেন না উনি কি রকম ভোটটা করেছেন। উনি কি জানেন নাই যে ১৮ কোটি মানুষের ভোট বঞ্চিত করছেন। ভোটাধিকার হরণ করে আপনি যখন দিন শেষে বা পরের দিন নির্বাচনী ফলাফলটা দিয়ে দিলেন এ অত পাইছে, অমুক অত পাইছে, এ ও পাস করছে, এই যে আপনার স্বেচ্ছাচারিতা ইচ্ছেমতো ফলাফল ঘোষণা করা বা এনডোরস বাই গভর্নমেন্ট, আপনি সাংবিধানিক পদে থেকে এটা আপনি সাংবিধানিক মব করেছেন।
এরপর আসেন একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে অপারেশন ডালভাতের অজুহাতে ৫৭ জন সেনা অফিসার মারা গেল, তার সাথে সিভিল ১৪ জন, অপারেশন ডালভাত কি যেদিন ঘটেছে সেদিন সকালের, নাকি আরো ১৫ দিন পিছনের বা দুই মাসের জের। যদি তাই হয় তাহলে রাষ্ট্র সেটা জানল না কেন? একটা রাষ্ট্র যখন ৫৭ জন সেনা অফিসার মারার পর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেখানে উদ্ধার করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, তার মানে হচ্ছে ওই হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্র অ্যাপরুভাল দিয়েছে, এটাকে বলা হয় রাষ্ট্রীয় মব। আরেকটু পিছনে যান, বিদ্যুতের জন্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে রাস্তায় মানুষ মিছিল করছিল, সেখানে পুলিশ গুলি করে নিরীহ ২৪ জনকে হত্যা করল, এটা কোনো আইনে আছে যে রাষ্ট্রকে কি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে তুমি প্রভাব বিস্তার কর, আন্দোলন কমিয়ে দাও, বিদ্যুতের দাবিতে যারা মাঠে নেমেছে তাদের গুলি করে হত্যা কর। এটাকে বলে রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক মব। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে নির্বিচারে গুলি চালানো হলো, সেটা কি রাষ্ট্র অ্যাপ্রুভাল দিতে পারে? কোনো আইনে পারে? এটা রাষ্ট্রীয় মব। যদি চিন্তা করেন রাষ্ট্র যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে মব অ্যাপ্রুভ করে তাহলে?
এবার আরেকটা কথা বলি। অর্থনৈতিক মব। ব্যাংক থেকে এস আলম টাকা নিয়ে গেল, ইচ্ছেমতো, নিয়ে গেলাম দিতে হবে না, আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংক থেকে নিল, তাকে কেউ টাচ করে না। সাইবার হ্যাক করে বিদেশে টাকা পাচার হয়ে গেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান চলে গেল ওনাকেও কেউ টাচ করে না। বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুকে কেউ টাচ করে না। সালমান রহমানের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী কেউ তাকে টাচ করে নাই। এসব কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক মব।
নয়া দিগন্ত : আইনজীবী হিসেবে আপনি কিভাবে মব’কে চিহ্নিত করবেন, কেউ গায়ের জোরে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে নাকি বিচার বিলম্বিত হলে কোনো পক্ষ বিক্ষুব্ধ হয়ে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য হচ্ছে?
আবু হেনা রাজ্জাকী : মব বলতে যদি আপনি এক কথায় বলেন, সেটা হলো নিজের বিচারটাকে হাতে তুলে নেয়া, এক নম্বর। এটার মানে হচ্ছে যে যেই অপরাধই করুক সেই অপরাধের জন্যে তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এটা হলো বিধান এবং এটা না করে আপনি কারো কাছে টাকা পাবেন সেজন্যে তাকে ধরে মারছেন রাস্তায় যাচ্ছেতাইভাবে, সে টাকা নিয়েছে এটা ফ্যাক্ট, কিন্তু আপনি টাকা আদায়ের জন্যে যে তাকে মারছেন, এটাকে বলে মব। মানে আপনি গায়ের জোর দেখাচ্ছেন। অর্থাৎ জোর দেখানো, জোর দিয়ে আইনটাকে সুপারসিট করা। আবার পাশাপাশি আরেকটা দিক আছে, আপনি যদি আইনের কাছে যান, ইউ আর নট গেটিং রিলিফ, দিচ্ছি দিব বলে আপনাকে ঘুরাচ্ছে। তো মব বলে সেটাকে যে বিচারটাকে নিজে করতে চায়, অধিকারটা নিজে আদায় করতে চায়, বিয়ন্ড দ্য ল, আইনের বাইরে গিয়ে।