অনিয়মই যেন নিয়ম ছিল সাবেক মন্ত্রী আবদুুল লতিফ সিদ্দিকীর। সরকারি কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেননি সাবেক এই বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী। যেমনটা হয়েছে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) বেলায়। ২০০৯-১৪ মেয়াদে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ছিলেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠান জেডিপিসিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকসহ ৩০ জনকে নিয়োগ দেন। যোগ্যতা না থাকলেও স্বজনপ্রীতি ও আওয়ামী লীগ বিবেচনায় এই নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে এখনো ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বহাল রয়েছেন। এদের মধ্যে পরিচালক (এমআরপি) সীমা বোস অধরাকে মির্জা আজম বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর আমলে এক অফিস আদেশে তার চাকরি পুনর্বহাল করা হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখনো দাপটের সাথেই রয়েছেন। পরিচালক সীমা বোস অধরাসহ অন্যদের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়াদের বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ৬ অক্টোবর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মাঝপথে তদন্ত কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। প্রায় বছর পেরুতে চললেও ওই তদন্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।
জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২০ কোটি টাকার অনুদানে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠা করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব বহুমুখী পাটপণ্যকে দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি ও প্রমোট করা। জেডিপিসি প্রতিষ্ঠাকালীন সময় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পাটখাতের দক্ষ ও অভিজ্ঞদের মধ্য থেকে একজন নির্বাহী পরিচালক ও দুইজন পরিচালকসহ ১৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তখনকার বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুুল লতিফ সিদ্দিকী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালকদের অপসারণ করেন। কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাড়াই ৩০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেশির ভাগের বাড়ি আবার লতিফ সিদ্দিকীর নিজ জেলা টাঙ্গাইলে। জেডিপিসিতে নিয়োগ লাভের আগে এদের বেশির ভাগই সরাসরি আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।
নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান টাঙ্গাইল জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মোখলেসুর রহমান। এই পদে নিয়োগ পাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকলেও শুধু দল ও স্থানীয় কোটায় নিয়োগ পান তিনি। অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়ে তিনিও শুরু করেন দুর্নীতি, অনিয়ম। নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনিও জনবল নিয়োগ দিতে থাকেন। ফলে অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় জেডিপিসি। আওয়ামী আমলেই চাকরি হারান নির্বাহী পরিচালকসহ কয়েকজন। কিন্তু এখনো বহাল রয়েছেন নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়াদের অন্যতম জেডিপিসির পরিচালক (এমআরপি) সীমা বোস অধরা। লতিফ সিদ্দিকীর জেলায় নারী কর্মকর্তাকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০১০ সালের ৪ মে নিয়োগ দেয়া হয়। চাকরিবিধি অনুযায়ী পরিচালক পদের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েটসহ পিএইচডি থাকতে হবে। ২০ বছরের এক্সপোর্ট প্রমোশন, সেলস প্রমোশন এবং মার্কেটিং ও মার্কেট সার্ভে থাকতে হবে শিল্প পণ্যে। কিন্তু কোনোটাই ছিল না তার। সীমা বোস অধরার সিভিতে উল্লেখ করা হয়, তিনি ১৯৮৫ সালে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসী সরকারি কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেছেন। এইচএসসি পাস করেছেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৩ সালে বিএ পাস করেছেন। ১৫ বছর পর ২০০৮ সালে বিবিএ এবং ২০০৯ সালে এমবিএ পাস করেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসান থেকে। সার্টিফিকেট বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টি দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ। সীমা বোসসহ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই লতিফ সিদ্দিকীর মৌখিক নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ১১ জনের বাড়িই টাঙ্গাইলে। এদের মধ্যে ট্রেনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিকিউটিভ পদে মো: জাহাঙ্গীর আলম ২০১৭ সালে তখনকার বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মির্জা আজমের মৌখিক নির্দেশে নিয়োগ পান। জাহাঙ্গীর সরাসরি যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। বাকিদের লতিফ সিদ্দিকী ও তার নিয়োগকৃত ইডি মোখলেসুর রহমান নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। এর বাইরে ২০১৭ সালে নিজ এলাকা জামালপুরের মো: মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে জেডিপিসির প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্রের ম্যানেজার সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং হিসেবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাড়াই মৌখিক নির্দেশে নিয়োগ দেন মির্জা আজম।
জেডিপিসির প্রজেক্ট মেমোরেন্ডামের চাকরি যোগ্যতা অনুযায়ী পরিচালক (এমআরপি) যোগ্যতা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, পিএচডি ডিগ্রি ও মার্কেটিংয়ের ওপর ২০ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু সীমা বোস অধরার এই যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও চাকরি পান এবং করছেন। যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সিনিয়র ডিজাইন অ্যান্ড ফ্যাশন এক্সিকিউটিভ নুসরাত জাহান, ট্রেনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এক্সিকিউটিভ মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পলি গুহ এবং ম্যানেজার সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মো: মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে দাপটের সাথে চাকরি করছেন।
জানা যায়, ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি বিনা ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। লতিফ সিদ্দিকী দফতর পরিবর্তন হয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। হজ ও শেখ হাসিনাপুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়ে বিরূপ মন্তব্যের জেরে ওই বছরের অক্টোবরে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হয়। পরে দল থেকেও বাদ দেয়া হয়।
জেডিপিসিতে লতিফ সিদ্দিকীর প্রভাবে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সীমা বোস অধরাকে ২০১৮ সালের ৮ মে চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব মো: ফয়জুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত অধরাকে অব্যহতি দেয়ার চিঠির সূত্রে জানা যায়, তখনকার বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের জন্য তিনটি পাটের শাড়ি কেনার দায়িত্ব দেয়া হয় অধরাকে। তিনি দু’টি শাড়ির মূল্য ৪৫ হাজার টাকা করে ৯০ হাজার এবং আরেকটির দাম ৪৮ হাজার টাকার বিল গ্রহণ করেন। রূপগঞ্জ থেকে এই শাড়ি কেনা হয়। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা প্রতিটি শাড়ির মূল্য যাচাই করে দেখেন প্রতিটির দাম ১৪ হাজার টাকা করে। তার আগের দুই বছর জাতীয় পাট দিবসের অনুষ্ঠানে প্রদত্ত শাড়িগুলোর দামও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়েছে। এগুলোও সীমা বোস অধরার কেনার দায়িত্ব ছিল। চিঠিতে বলা হয়, এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, আপনি আপনার দায়িত্ব সততার সাথে পালন করতে পারেননি। এ বিষয়ে তাকে কারণ দর্শানোর পরিপ্রেক্ষিতে তার লিখিত জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানিকালে প্রদত্ত বক্তব্য কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তোষজনক না হওয়ায় নিয়োগপত্রের ‘ডি’ শর্তানুযায়ী ৯ মে থেকে জেডিপিসির চাকরি হতে অব্যহতি প্রদান করা হলো মর্মে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
২০১৮ সালের রাতের ভোটে নতুন করে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী হন গোলাম দস্তগীর গাজী। বছর খানেক আগে অব্যহতি পাওয়া সীমা বোস অধরাকে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে এক অফিস আদেশে অব্যহতির আদেশ রদ ও রহিত করে আনীত অভিযোগ হতে অব্যহতি দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।
এ বিষয়ে সীমা বোস অধরা জানান, আমাকে অব্যহতি দেয়ার পর মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলাম। তার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি পুনর্বহাল করা হয়। তিনিসহ কারো চাকরিই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হয়নি বলে স্বীকার করে অধরা জানান, আমাদের ২২-২৩ জনের মতো মৌখিক পরীার মাধ্যমে চাকরি দেয়া হয়। এটা শুধু আমাদের ক্ষেত্রে নয়, আগেও হয়েছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রজেক্ট মেমোর্যান্ডাম অনুযায়ী পরিচালক পদে পিএইচডি ডিগ্রির পাশাপাশি ২০ বছরের অভিজ্ঞতার নিয়ম থাকলেও তার এটি ছিল না বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, শুধু আমি কেন, নিয়োগপ্রাপ্ত কারোরই এমন অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রজেক্টের মাধ্যমে আমাদের নিয়োগ হয়েছে। তাই আমাদের নিয়োগে কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি করেন তিনি।
এ দিকে সীমা বোস অধরাসহ জেডিপিসিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তদের বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৬ অক্টোবর এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগসমূহ তদন্তপূর্বক জরুরিভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বাজেট) ড. মো: মনিরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ড. মো: মনিরুজ্জামান গত মে মাসে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন তিনি দিয়ে যেতে পারেননি। অন্য কেউ তার জায়গায় দায়িত্ব পেয়েছেন কিনা-তাও বলতে পারেননি তিনি। পাট অনুবিভাগে খোঁজ নিয়ে নতুন কাউকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা শুধু নিশ্চিত করেন এখনো জেডিপিসি সংক্রান্ত অভিযোগের কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি।
সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ৭১ মঞ্চ নামে আওয়ামী লীগের একটি সংগঠনের অনুষ্ঠান থেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকার সময় কোনো প্রকার আইনকানুন, নিয়মনীতির ধার ধারেননি তিনি। নিয়ম ভঙ্গ করে তিনি সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন। ২০১৪ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের সময় ৪৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তর বা বিক্রি করেছেন বলে জানা যায়। এ সময় দু’টি ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠান বিনা দরপত্রে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে বেসরকারীকরণ বা বিক্রি করা হয়। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বেশির ভাগ েেত্রই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছেন।