হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে ভেঙে পড়েছে আ’লীগ

পতিত দলটির সর্বোচ্চ নেতা শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হওয়ায় মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব। রায় যাতে ঘোষণা করতে না পারে সেজন্য গত কিছুদিন যাবৎ অন্তর্বর্তী সরকার ও আদালতকে নিয়ে নানা হুমকি ধমকিসহ তির্যক মন্তব্য ছুড়ে বক্তব্য দিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশেষ করে রায় ঠেকাতে গত এক সপ্তাহ ধরে লকডাউন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল এবং শাটডাউনের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করে জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক তৈরির ছক কষে পতিত দলটি।

মনিরুল ইসলাম রোহান
Printed Edition

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও পতিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলার প্রথম রায় গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ঘোষণা করেছেন। পতিত দলটির সর্বোচ্চ নেতা শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হওয়ায় মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েছে তৃণমূল থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব। রায় যাতে ঘোষণা করতে না পারে সেজন্য গত কিছুদিন যাবৎ অন্তর্বর্তী সরকার ও আদালতকে নিয়ে নানা হুমকি ধমকিসহ তির্যক মন্তব্য ছুড়ে বক্তব্য দিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিশেষ করে রায় ঠেকাতে গত এক সপ্তাহ ধরে লকডাউন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল এবং শাটডাউনের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করে জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক তৈরির ছক কষে পতিত দলটি।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা আলাপকালে এ প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার চিন্তা বাদ দিয়ে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বিচারকার্যক্রমকে নিয়ে বেশি চিন্তিত। আদালত যদি শেখ হাসিনার রায় ঘোষণা করতে পারে তাহলে আগামী নির্বাচনও করে ফেলতে পারবে- এই ধারণাকে মাথায় রেখেই মূলত পরিকল্পনা সাজানো হয়েছিল। এজন্য দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করা হয়েছিল। ১৭ তারিখ অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য ঢাকাকে বেছে নেয়া হলেও নেতাকর্মীরা ওইভাবে কেউ মাঠে নামেনি। ওই নেতা আরো বলেন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অগোচরে ঢাকার বিভিন্ন অলিতে গলিতে ঝটিকা মিছিল বের করার কথা ছিল।

ঢাকার বাইরে কিছু জেলায় শাটডাউন কর্মসূচি পালন হলেও কঠোর নিরাপত্তার কারণে ঢাকায় নামতে নেতাকর্মীরা সাহস পায়নি। তা ছাড়া ১৩ তারিখ লকডাউনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। এর আগে যারা গ্রেফতার হয়েছিল ছাড়া পেয়ে তাদের বেশির ভাগই হতাশায় ভুগছে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এখন দলীয় সভাপতির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলেও মাঠে নামার মতো নেতাকর্মী আসলে নেই বললেই চলে। প্রত্যেকেরতো পরিবার রয়েছে। অনেকেই আছে গ্রেফতার হলে তাদের পরিবার দেখভাল করার মত কেউ থাকে না, জামিন ধরারও কেউ নেই। এখানে নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতারাতো বিদেশে গিয়ে আরাম আয়েশে রয়েছেন, কিছু হলেই কর্মসূচি ঘোষণা করছেন এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিয়েই শেষ করছেন। এ বিষয়টিও তৃণমূল পর্যায়ের ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারছে।

রাজনৈতিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করেছিল বিদেশে বসে থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাদের নেত্রীর রায় ঘোষণার প্রতিবাদে মাঠে নামবেন, আন্দোলন করবেন, দু-চারটি বাসে আগুন দিয়ে হলেও আতঙ্ক ছড়িয়ে আগুন সন্ত্রাস করে তাদের শক্তিমত্তা জানান দিবেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা এখন বুঝতে পারছেন তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্য দলটির শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হলেও কার্যত প্রতিবাদ করার জন্য কার্যত কেউ মাঠে নামেনি। বিশেষ করে ঢাকার মতো জায়গায় তাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ফলাও করলেও কেউ প্রতিবাদ মিছিল পর্যন্ত করার সাহস দেখাতে পারেনি। এতে বোঝা যায়, অতীতের আচরণে তৃণমূল দিনদিন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।

এদিকে গত ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচারের রায় ঘোষণার দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। ওই দিন আদালত যাতে রায়ের তারিখ ঘোষণা করতে না পারে সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা লকডাউন ঘোষণা করে পতিত আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই বিদেশে এবং আত্মগোপনে রয়েছেন। বিশেষ করে ভারতের কলকাতা ও দিল্লিতে অবস্থান করা শীর্ষ নেতৃত্ব সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে অডিও-ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ ও আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের উসকানি দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাসে আগুন দেয়াসহ নানা নাশকতায় মেতে উঠলেও গতকাল দলটির আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের রাজধানীতে একটি প্রতিবাদ মিছিল করার চিত্রও চোখে পড়েনি। যদিও রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বাসে আগুন লাগানোর ঘটনায় এর আগে ছাত্রলীগের একটি বড় অংশকে আটক করে পুলিশে দেয়া হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে নিরাপদে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে পতিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ও সরকারের মন্ত্রিপরিষদসহ আওয়ামী লীগের পুরো বডি আত্মগোপনে চলে যান। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পতিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা জুলাই গণহত্যার দায় মাথায় নিয়ে ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করছেন। সেই সাথে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ এবং সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের একটি বড় অংশসহ ক্ষমতাচ্যুত দলটির এমপি-মন্ত্রীর একটি বড় অংশ মিলে অন্তত দুই হাজার জনশক্তি ভারতের কলকাতার নিউটাউন, ইডেন গার্ডেন ও তার আশপাশে অবস্থান করছেন।

৫ আগস্ট বিতাড়িত হওয়ার পর পলাতক নেতাকর্মীরা সর্বত্র কোণঠাসা হয়ে পড়েন। যদিও রাজনৈতিক নানা মেরুকরণে এক বছরের মাথায় ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন পতিত দলটির নেতাকর্মীরা। কেউ ইউটিউব চ্যানেলে, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, কেউ কেউ ছোট পরিসরে ঝটিকা মিছিল নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন অলিতে গলিতে সক্রিয় অবস্থান জানান দিচ্ছেন দলটির তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে হাইকমান্ডের নেতৃত্ব। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার রায়ের তারিখ ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে পতিত দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব কলকাতায় বসেই সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে নাশকতার ছক বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশনা দেন।

সেই নির্দেশনা পেয়ে প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল বের করেন তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। অন্তর্বর্তী সরকারকে হুমকি দিয়ে পতিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ইউটিউব চ্যানেল দ্য রিপাবলিক এক্সপ্রেস ও নতুন সময়কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘উন্নয়নের রোল মডেল শেখ হাসিনার নামে মিথ্যা ভিত্তিহীন বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দিয়ে অবৈধ ইউনূস সরকারের অবৈধ অস্থায়ী আদালত মামলার নাটক মঞ্চস্ত করে মামলার রায়ের দিন ধার্য করেছে। ৮৫ শতাংশ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় যিনি রয়েছেন অবৈধ সরকারের অবৈধ অস্থায়ী আদালত কোনো রায় দিয়ে রায় চাপিয়ে দেবে বাংলার জনগণ তা মেনে নেবে না।

এদিকে আরেকটি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা এবং অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার হুমকি দেন পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। যদিও সব হুমকি ধমকি উপেক্ষা করে পতিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার রায় ঘোষণা হওয়ায় আওয়ামী লীগের সব আশা ফিকে হয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম। তিনি বলেন, এ রায় ছাত্র-জনতার আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। শেখ হাসিনা একজন ফ্যাসিস্ট খুনি ও স্বৈরাচার শাসক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। মাসুম বলেন, শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহায়তায় তারা আবার কোন ষড়যন্ত্র করে- সেটার বিষয়েও অন্তর্বর্তী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।