প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি নগণ্য

শেখ হাসিনার ১৭ সচিব এখনো বহাল

এমনকি পছন্দের সচিবকে পদায়ন না করায় পদায়ন হওয়া দুইজন সচিবকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে দেননি দুইজন উপদেষ্টা। পদোন্নতি পদায়নেও আর্থিক লেনদের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

শামছুল ইসলাম
Printed Edition
বাংলাদেশ সচিবালয়ের নতুন ভবন
বাংলাদেশ সচিবালয়ের নতুন ভবন |ফাইল ফটো

দেশের শাসনব্যবস্থার আমূল সংস্কারের প্রত্যাশায় গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরেও সেই শাসনব্যবস্থা প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। বরং প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি খুবই নগণ্য। সেবা সংস্থার দফতরগুলোতে ঘুষ-অনিয়ম-দুর্নীতি-নাগরিকদের হয়রানি বন্ধ হয়নি। বিচারের আওতায় আসেনি পলাতক শেখ হাসিনার সহযোগী আমলারা। উপরন্তু তার ঘনিষ্ঠ ১৭ সচিব এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। মন্ত্রীদের মতো অবৈধ ডিও কালচার বহাল রেখেছেন খোদ উপদেষ্টারাও। এমনকি পছন্দের সচিবকে পদায়ন না করায় পদায়ন হওয়া দুইজন সচিবকে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে দেননি দুইজন উপদেষ্টা। পদোন্নতি পদায়নেও আর্থিক লেনদের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক বছরে নিয়মিত ও ভূতাপেক্ষ মিলিয়ে এক হাজার ৫৪৯ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপ সচিব পদে ১৪১ জন, যুগ্ম সচিব পদে ৪২৪ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৪৯ জন, গ্রেড-১ পদে ২৬ জন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদে ৪৫ জনসহ সর্বমোট ৭৮৫ জন কর্মকর্তাকে নিয়মিত পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে উপ সচিব পদে চার, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮ জন, গ্রেড-১ পদে ৪১ জন এবং সচিব পদে ১১৯ জনসহ সর্বমোট ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এক বছরে অতিরিক্ত সচিব পদের ১৯ জন, গ্রেড-১ পদের একজন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদের নয়জনসহ সর্বমোট ২৯ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে।

এ সময়ে উপ সচিব পদের ১৬ জন, যুগ্ম সচিব পদের ১৫ জন, অতিরিক্ত সচিব পদের ৭৫ জন, গ্রেড-১ পদের ৩৪ জন এবং সচিব-সিনিয়র সচিব পদের ২৪ জনসহ সর্বমোট ১৬৪ জন কর্মকর্তা কর্মকাল শেষে স্বাভাবিক অবসরে গেছেন। এক বছরে ২৪টি বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে, আটটি বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। এ ছাড়াও ১৬টি বিভাগীয় মামলা চলমান। প্রশাসনিক তদন্ত শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস এবং লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এক বছরে তিনটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন, তিনটি বিধিমালা সংশোধন, একটি বিশেষ বিধিমালা প্রণয়ন এবং ২২টি নিয়োগ বিধিমালা বা প্রবিধানমালা প্রণয়ন বা সংশোধনে সুপারিশ করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান ড. মো: মোখলেস উর রহমান। এরপর জনপ্রশাসনে পদোন্নতি পদায়নে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে আগের সরকারের ফিটলিস্টে থাকা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক পদায়নের ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েকজন পদায়ন হওয়া জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জনপ্রশাসনের পদায়ন পদোন্নতির এসব কাজ সে সময় নিয়ন্ত্রণ করেছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন সিনিয়র অফিসার। তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বসে দোসর কর্মকর্তাদের ডিসি হিসেবে পদায়ন করেন। এই পদায়নে আর্থিক কেলেঙ্কারি অভিযোগ উঠলে সেই সময়ের দুইজন ডেস্ক অফিসারকে বদলি করা হয়। যাদের পূর্ববর্তী কর্মজীবনে আর্থিক অসততার কোনো অভিযোগ ছিল না।

ডিসি নিয়োগে বিতর্কের পর পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি-পদায়নগুলোতেও বির্তকের জন্ম দেয়। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল, তাদের পদোন্নতি এবং পদায়নে সক্রিয় হয় একটি চক্র। ওই চক্রের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রীদের মতো অবৈধ ডিও কালচার শুরু করেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুইজন সচিবকে পদায়ন করে। কিন্তু তারা নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তা না হওয়ায় তাদেরকে যোগদান করতে দেননি দুইজন উপদেষ্টা। এ ঘটনা তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।

ঝুলে আছে দুই স্তরের পদোন্নতি : অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তড়িঘড়ি করে কয়েক দফা পদোন্নতি দেয় সরকার। এসব পদোন্নতিতে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এরপর যুগ্ম সচিব পদোন্নতি দিলেও ঝুলে আছে উপ সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি। অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন অনুবিভাগে কর্মকর্তা নেই। অনেকগুলো দফতর, সংস্থায় চেয়ারম্যান, ডিজি পদে পদায়ন করা যাচ্ছে না উপযুক্ত কর্মকর্তার অভাবে। এমন বাস্তবতায় অনেকদিন ধরেই প্রশাসনে ঝুলে আছে অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি। একইভাবে উপ সচিব পদোন্নতিও ঝুলে আছে দীর্ঘ দিন ধরে। প্রয়োজনীয় তথ্য, উপাত্ত প্রস্তুত থাকার পরেও এসএসবি’র সভা করে যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে পারছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

ডিসি পদায়নে জটিলতা কাটেনি : পাঁচ মাস আগে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন ১৯৬ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে ২১ জন এখনো বহাল রয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির পর তাদের মাঠ প্রশাসন থেকে ফিরিয়ে আনার রেওয়াজ থাকলেও নতুন ডিসি পদায়ন করতে পারেনি। এ নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

শেখ হাসিনার ১৭ সচিব এখনো বহাল : শেখ হাসিনার আমলে সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ১৭ সচিব এখনো বহাল রয়েছে। এসব কর্মকর্তারা হলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, অর্থ বিভাগের সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য রুহুল আমিন, পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সচিব আমিন উল আহসান, বিপিএটিসির রেক্টর সাঈদ মাহবুব খান, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোকাব্বির হোসেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা: মো. সারোয়ার বারী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমির রেক্টর ড. মো: ওমর ফারুক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আশরাফ উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরী, বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরিফা খান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সংযুক্ত সচিব মোহাম্মদ মাহমুদুল হোসাাইন খান, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আব্দুর রউফ।