মাদরাসার শিক্ষাকাঠামোর সঙ্কট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা- ৭

প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বৈষম্যের শিকার ইসলামী শিক্ষা

সরকারি পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দিচ্ছে দেশে সরকারিভাবে ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও মহল বিশেষের উদাসীনতা ছিল।

শাহেদ মতিউর রহমান
Printed Edition
প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বৈষম্যের শিকার ইসলামী শিক্ষা
প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বৈষম্যের শিকার ইসলামী শিক্ষা

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই উপেক্ষিত হয়ে আসছে মাদরাসা শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামো সংস্কারে যেভাবে সরকার আর্থিক বরাদ্দ তথা বাজেটে গুরুত্ব দিয়ে থাকে সেখানে মাদরাসার জন্য সরকারের মনোযোগ নেই বললেই চলে। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে দেশের সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসা শিক্ষার অন্তহীন বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নানা পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষার আশানুরূপ গুরুত্ব দেয়া হয়নি কোনোকালেই। সরকারি পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দিচ্ছে দেশে সরকারিভাবে ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও মহল বিশেষের উদাসীনতা ছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৩ হাজার ৫০০টি এবং সরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৫৫টি। বর্তমান দেশে সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। কিন্তু এর বিপরীতে সরকারি মাদরাসার সংখ্যা একেবারেই কম। দেশে সরকারি আলিয়া মাদরাসার সংখ্যা মাত্র তিন। এ তিনটি হলো ঢাকা আলিয়া মাদরাসা, সিলেট আলিয়া মাদরাসা এবং বগুড়ার সরকারি মুসতাফিয়া আলিয়া মাদরাসা।

একটি মাত্র মাদরাসার শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সারা দেশের দাখিল এবং আলিম পরীক্ষার মতো বড় পরিসরের বোর্ড পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষা বোর্ড রয়েছে নয়টি। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেটে, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও বরিশাল শিক্ষা বোর্ড। এ ছাড়া একটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের ভোকেশনাল পরীক্ষায় অংশ নেয়া হয়।

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সাধারণ ৯টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চলতি ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে প্রায় এক লাখ। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অংশ নেয়া দাখিল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের দাখিলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল দুই লাখ ৯৫ হাজার ৭২৬ জন। গত বছরের তুলনায় এবার দাখিলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩ হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা বোর্ড এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে অংশ নেয়া মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ লাখ ২৮ হাজার ১৮১ জন। পরিসংখ্যান বলছে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেখানে কমেছে সেখানে মাদরাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এরপরও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা আনুপাতিক হারে বাড়ছে না।

মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বৈষম্যের আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি। দেশে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য টিচার্স ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে ৫৩টি। সরকারি টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ রয়েছে ১০টি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ইসলামী শিক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (সরকারি) রয়েছে মাত্র একটি । এটিও ঢাকার বাইরে গাজীপুরে অবস্থিত।

দেশে শুধু মাদরাসার শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধাই অপ্রতুল নয় বরং মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও শুরু থেকেই নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম শ্রেণী থেকেই যেখানে আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে উপবৃত্তি চালু করা হয়েছে সেখানে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যূনতম সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় না। এরপরও দেশে মাদরাসার সংখ্যা এবং দিনে দিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক বাড়ছে। তবে সরকার যদি সাধারণ শিক্ষার মতো মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষার জন্য আরেকটু উদার মন নিয়ে মাদরাসাগুলোর পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে এদেশে ইসলামী শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বহুলাংশেই বাড়বে।

অবশ্য শুরু থেকেই সরকারি সাহায্য এবং সহযোগিতা ছাড়াই ১৮৬৬ সাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অভিভাবকদের আর্থিক অনুদান দিয়ে শুরু হয় ইসলাম শিক্ষার প্রাচীনতম মৌলিক ধারা কওমি মাদরাসা। প্রায় একই সময়ে সাহারানপুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর সেখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তরা উপমহাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় একই ধারায় ও নীতিতে মাদরাসাগুলো গড়ে তোলেন। আমাদের এ বাংলাদেশে যেসব প্রসিদ্ধ কওমি মাদরাসা চালু আছে, সেগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন শুধু বাংলাদেশেই কয়েক হাজার ছোটবড় কওমি মাদরাসা চালু আছে। সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠান মুসলিম উম্মাহর শিশু ও তরুণদেরকে ইসলামের শিক্ষায় ও ভাবধারায় গড়ে তোলার মহান খেদমত করে যাচ্ছে। সে কারণেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও আনুকূল্য না থাকলেও জনসাধারণের আস্থা অটুট রয়েছে। জনগণের এই সুধারণা ও বিশ্বাসই কওমি মাদরাসাগুলো টিকে থাকার ও উন্নতি লাভ করার প্রধান কারণ।

আশার কথা হচ্ছে, ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকার মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে আন্তরিতার সাথে কাজ শুরু করেছে। দেশের ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। একাধিক ধাপে এসব ইবতেদায়ি মাদরাসাগুলো জাতীয়করণ করা হলে এদেশের মাদরাসা শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের একটি দাবি পূরণ হতে চলেছে। একই সাথে যেসব আলিয়া মাদরাসায় অবকাঠামোগত নানা অসুবিধা ছিল সেগুলোর তালিকা প্রস্তুত শুরু হয়েছে। এমপিওভুক্ত এসব মাদরাসার ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে শিক্ষকসঙ্কট নিরসনেও সরকারি বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে খুব শিগগিরই সরকারের এসব উদ্যোগ পিছিয়ে পড়া মাদরাসাগুলো সুফল পাবে। অন্যদিকে দেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্যও সরকার একটি স্কলারশিপ প্রোগ্রাম চালু করেছে।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা কাতারের সাথে একটি নতুন চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের মাদরাসার শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাতার সরকার বড় আকারের আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে বিদেশী এই আর্থিক সহযোগিতায় এ দেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিষয়ে আরো বেশি দক্ষ ও জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হবে।