২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। আইন অঙ্গনে সুনাম না থাকলেও বিএনপি-জামায়াত দমনে বিচারাঙ্গনে দলীয় প্রভাব তৈরি ও হস্তক্ষেপে পারঙ্গম ছিলেন তিনি। তার অনৈতিক হস্তক্ষেপে বিচারাঙ্গনে অবিচারের শিকার হন বিরোধীমতের মানুষ। প্রতাপশালী এই প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) আহমেদ ফয়সল ইমাম। দীর্ঘ পাঁচ বছর তিনি পিএস হিসেবে ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফ্যাসিবাদী আমলের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা কামরুল ইসলাম কারাগারে আছেন। কিন্তু তার পিএস পর্যায়ক্রমে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে এখন প্রতাপশালী কর্মকর্তা।
গত আগস্ট মাসে দৈনিক নয়া দিগন্তে নন ইউরিয়া সার সঙ্কট ও মাঠের অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের জেরে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক কাওসার আজমকে জেল খাটানোর হুমকি দিয়েছেন। নিজেকে একজন জাদরেল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দাবি করে আহমেদ ফয়সল ইমাম গর্ব করে বলেন, মিথ্যা তথ্যের জন্য এক সাংবাদিককে আমি দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে এসেছি, যখন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। আমার এ অভিজ্ঞতা আছে। আমি খুব জাদরেল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। যেসব জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেসি করেছি, খোঁজ নিতে পারেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমিই প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট যে সম্পাদক কাম সাংবাদিককে দুই বছর জেল দিয়েছি। লক্ষ্মীপুরে ওই সাংবাদিককে কারাদণ্ড দেন বলে গর্বের সাথে বলেন তিনি। ২০০৪-০৬ সালে তিনি সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয়ে নিযুক্ত ছিলেন।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষক সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার পাচ্ছে না। মাঠে সার নিয়ে অব্যবস্থাপনার বিষয়ে গত ১৯ আগস্ট ‘বেশি দামে কিনতে হচ্ছে সার, সঙ্কটের পেছনে কারা?’ শিরোনামে দৈনিক নয়া দিগন্তে খবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার কাওসার আজম প্রতিবেদনটি করেন। এই নিউজে নন ইউরিয়া সারের মজুদ, সরবরাহ ও মাঠপর্যায়ে কৃষককে অতিরিক্ত দামে সার কিনতে বাধ্য হওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি ঠিক সময়ে সার আমদানি করতে না পারায় বাড়তি দাম দিয়ে নন ইউরিয়া সার আমদানি, বেসরকারিভাবে সাড়ে ৯ লাখ টন নন ইউরিয়া সার আমদানির বিষয়টিও উঠে আসে প্রতিবেদনে। উঠে আসে ডিলারশিপ সিন্ডিকেটের তথ্যও।
সারা দেশে নন ইউরিয়া সার সঙ্কটের সমাধান হয়নি এখনো। নন ইউরিয়া সার নিয়ে মাঠে অব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি পর্যায়ের আমদানির টেন্ডার বা দরপ্রস্তাব নিয়েও নানা অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সার উইংয়ের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। বিশেষ করে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ করে নন ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন পেয়েছে, তা জানতে গত ৭ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব খোরশেদ আলমের কাছে গেলে তিনি প্রথম দিন তথ্য না দিয়ে পরের দিন আসতে বলেন। পরদিন (৮ সেপ্টেম্বর) তার কাছে গেলে তিনি ব্যস্ত আছেন জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমামের কাছ থেকে তথ্য নিতে বলেন। তার রুমে গিয়ে তথ্য চাওয়া হলে তিনি তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে বলেন। একপর্যায়ে তিনি নয়া দিগন্তে প্রকাশিত আগের নিউজের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চকিত কণ্ঠে বলেন, ‘অন্যায় একটা নিউজ করেছেন, না জেনে না বুঝে নিউজ করেছেন। ব্যস্ততার কারণে জবাব দেইনি। আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশনেও যাইনি। আপনার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায়।’ এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারণ আপনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, সম্মানহানি করেছেন। মানহানি মামলা তিনটা হয়।’ নিউজে ভুল তথ্য কী-জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, আমি খাচ্ছি তো (দুপুরে)। পরে আইসেন দেখায়ে দেবো যে, নিউজে মিথ্যা কী কী আছে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আইন কী, আইনের কত ধারা-আমাদের চেয়ে আর ভালো কেউ জানে না। আমরা জানি, কোন আইন দিয়ে কারে কিভাবে ধরতে হবে। হাতে ছাই মাখিয়ে ধরব। কিন্তু ধরি নাই ইচ্ছা করেই। কতজন তো কত কথাই লিখছে।’
জানা যায়, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তা আহমেদ ফয়সল ইমাম ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ থেকে ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের পিএস হিসেবে নিয়োগ পান। উপসচিব হিসেবে পদোন্নতির পর মাঝখানে ১০ দিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। এরপর ফের ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ থেকে কামরুল ইসলামের অভিপ্রায় অনুযায়ী আরো পাঁচ মাস (সরকারের মেয়াদ) পিএস ছিলেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনা ভোটের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠন করে। কামরুল ইসলামকে দেয়া হয় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০১৪ সালের ৬ জুলাই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে যোগদান করেন আহমেদ ফয়সল ইমাম। সেখানে ছিলেন সাড়ে চার বছরেরও বেশি। উপসচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হিসেবে প্রায় পাঁচ মাস জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। এরপর দুই বছর ৯ মাস সরকারি যানবাহন অধিদফতরের পরিচালক এবং প্রায় ৯ মাস স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ২০২৩ সালের ২৯ মে ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য হন। সেখানে নিয়োগ পেয়েই তিনিসহ অন্যরা গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এক বছর পাঁচ মাস সেখানে থাকা অবস্থায় জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
কামরুল ইসলামের পিএস হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে আহমেদ ফয়সল ইমাম বি-বাড়িয়ার কসবার ইউএনও ছিলেন। তার আগে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলা কর্মকর্তা ছিলেন বলে জানা যায়।