বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাত গত এক দশক ধরে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই দুই বাজারের বাইরে পণ্যের গন্তব্য বাড়াতে নানা কর্মসূচি নেয়া হলেও বাস্তবে তেমন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
তথ্যে দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রফতানি আয় ছিল ৫ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৪৪ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। অথচ একই সময়ে প্রচলিত বাজারগুলোতে রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট পরিমাণের অর্ডার, পর্যাপ্ত বাজার বিশ্লেষণ ও গবেষণার অভাব এবং রফতানিকারকদের পশ্চিমমুখী মানসিকতাই এই স্থবিরতার মূল কারণ। বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মোহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আমাদের অনেক উদ্যোক্তার চিন্তা এখনো পশ্চিমনির্ভর। ফলে নতুন বাজারের প্রবণতা, সংস্কৃতি বা চাহিদা নিয়ে আগ্রহ কম। এতে সম্ভাবনাময় অনেক বাজারে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরো জানান, দেশের বেশির ভাগ রফতানিকারক তৃতীয় পক্ষের বায়িং হাউজের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা কোনো বাজার গবেষণা বা কৌশলগত পরিকল্পনা করে না। তাই শিল্প সমিতি ও সরকার উভয়কেই এখন গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
রুবেল মনে করেন, সরকারের বাণিজ্য মিশন ও দূতাবাসগুলোকে অপ্রচলিত বাজারে আরো সক্রিয় হতে হবে। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে বাজার বিশ্লেষণ, ফ্যাশন ট্রেন্ড ও ভোক্তা আচরণ নিয়ে কাজ শুরু না করলে, এই বাজারে টেকসই অবস্থান তৈরি করা সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকা এই দু’টি বাজারেই বড় পরিমাণ অর্ডার পাওয়া যায়। অন্য দিকে, নতুন বাজারগুলো ছোট পরিসরে শুরু হয়, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ছোট অর্ডারে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে, তাই ক্রেতারা যদি বেশি দাম না দেন, তাহলে সেটি লাভজনক হয় না। আর অধিকাংশ কারখানা এখনো ছোট পরিমাণ অর্ডার ব্যবস্থাপনায় সক্ষম নয়।
কুতুবউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, নতুন বাজারগুলোতে আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য, স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে মানানসই কাপড় এবং ফ্যাশন ট্রেন্ড বোঝার মতো গবেষণা খুবই সীমিত। চীনের মতো দেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাজার গবেষণা করে, কিন্তু বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ নেই। অপ্রচলিত বাজারে রফতানির অন্যতম বড় বাধা হচ্ছে শুল্কনীতি ও নিয়ন্ত্রক জটিলতা। বাংলাদেশ এখনো অনেক দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা পছন্দনীয় বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করতে পারেনি। ফলে এসব দেশে রফতানি পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, বাংলাদেশ ব্রাজিল থেকে শূন্য শুল্কে তুলা আমদানি করে। কিন্তু আমাদের পোশাক ব্রাজিলে রফতানি করতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়। আমরা যদি শুল্ক ছাড় চাই, ব্রাজিল পাল্টা প্রস্তাব দেয় তারা বাংলাদেশে গোশত রফতানি করার, যা আমাদের কৃষিখাতের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, তারা ইতোমধ্যে কিছু দেশের সাথে পিটিএ আলোচনায় রয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। রফতানিকারকরা যদি যৌথভাবে সরকারের কাছে বাজার তথ্য সরবরাহ করে, তবে এটি দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পকে এখন বৈচিত্র্য, গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রচলিত বাজারে অতিনির্ভরতা দেশের বাণিজ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। প্রচলিত বাজারের বাইরে বিকল্প গন্তব্যে রফতানি বাড়াতে না পারলে, এলডিসি-পরবর্তী যুগে দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।



