মুক্ত বাণিজ্য, ইন্টারনেট ও স্বাস্থ্য খাতে নতুন অধ্যায়

বাংলাদেশ-ভুটান দ্বিপক্ষীয় আলোচনা

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভুটানকে বাংলাদেশের ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভুটান বাংলাদেশের ভিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন |পিআইডি

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে শনিবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, জ্বালানি, শিক্ষা, পর্যটন, ইন্টারনেট সহযোগিতা, পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ, পানিসম্পদ, বিনিয়োগ ও বিমান চলাচলসহ সম্পর্কের সামগ্রিক বিষয়াদি স্থান পায়।

শনিবার বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পৌঁছালে প্রথমে দুই নেতা প্রায় ৩০ মিনিট একান্ত বৈঠক করেন। এরপর প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভুটানকে বাংলাদেশের ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, আঞ্চলিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভুটান বাংলাদেশের ভিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৃতি আমাদের একত্র করেছে। আমাদের ভাগ্য একসাথে ভবিষ্যৎ গড়ার।’

জবাবে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে বলেন, বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে উষ্ণ ও চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি মধ্যযুগে বাংলার বৌদ্ধ ভিক্ষুরা হিমালয়ে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটিকে বাংলাদেশের ‘আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (ঋঞঅ) উদ্যোগ : দুই পক্ষই একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (ঋঞঅ) নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর বিষয়ে একমত হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভুটান ২০২০ সালে একটি প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (চঞঅ) স্বাক্ষর করেছিল।

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, থিম্পু যত দ্রুত সম্ভব এফটিএ স্বাক্ষর করতে আগ্রহী এবং বাংলাদেশর সাথে প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা দেশ হতে চায়। তিনি উল্লেখ করেন, এ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আরো গতিশীল হবে।

প্রধান উপদেষ্টা জানান, ভুটান থেকে পণ্য পরিবহন সহজ করতে কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যাতে ভুটানি কনটেইনার দ্রুত ছাড় করা হয়।

পর্যটন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সহযোগিতা : দুই দেশ পারস্পরিক পর্যটন বৃদ্ধি করতে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সম্মত হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ভুটানি পর্যটকদের বাংলাদেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখার প্রতি তিনি বিশেষ আগ্রহী। তিনি আরো জানান, নীলফামারীতে এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল ও একটি মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণাধীন রয়েছে এবং ভুটানি নাগরিকদের সেখানে চিকিৎসা সেবা ও মেডিক্যাল শিক্ষার সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।

বাংলাদেশ সরকার ভুটানি শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিক্যাল কলেজে আসন বৃদ্ধি করেছে এবং বুয়েটে (ইটঊঞ) আসন সংরক্ষণ করেছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জানান, তার দেশের অনেক শীর্ষ চিকিৎসক বাংলাদেশের মেডিক্যাল কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন।

চুক্তি স্বাক্ষর : স্বাস্থ্যসেবা ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ : আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে দুই দেশ দু’টি সমঝোতা স্মারক (গড়ট) স্বাক্ষর করে

১. স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সহযোগিতা

২. আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বাণিজ্য

এই চুক্তির আওতায় ভুটান বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানি করবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেন, এতে ভুটানের ডিজিটাল সংযোগ শক্তিশালী হবে এবং ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাস পাবে।

প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে আরো বাংলাদেশী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ভুটানে কাজের সুযোগ পাবেন, বিশেষ করে ভুটানের উন্নয়নাধীন নতুন অর্থনৈতিক শহর গেলেফুতে।

জলবিদ্যুৎ, নতুন অর্থনৈতিক শহর ও আঞ্চলিক সহযোগিতা : ভুটানের প্রধানমন্ত্রী গেলেফু মাইন্ডফুলনেস সিটি নামের একটি বড় অর্থনৈতিক হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানান এবং নারায়ণগঞ্জে ভুটানি পণ্য ওঠানামার জন্য জায়গা চেয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করেন।

দুই নেতা ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেন। এ ক্ষেত্রে ভারতকে যুক্ত করে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির সম্ভাবনাও আলোচনায় আসে।

পারস্পরিক প্রশংসা ও কূটনৈতিক সৌহার্দ্য : প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, ‘আপনার এই সফর আমাদের যৌথ ভবিষ্যৎ গড়ার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে থাকবে।’ তিনি ভুটানের কার্বন-নেগেটিভ দেশ হওয়ার প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক।

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, তারা এই পরিবর্তনকালীন সময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ‘উচ্চ লক্ষ্য অর্জন’ করেছেন।

ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করে শেরিং তোবগে জানান, সকালে বিমানবন্দরে প্রধান উপদেষ্টার নিজে তাকে অভ্যর্থনা জানানোয় তিনি ‘অত্যন্ত আনন্দিত ও আপ্লুত’ হয়েছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক, ডাভোস, বাকু ও ব্যাংককে ড. ইউনূসের সাথে পূর্ববর্তী সাক্ষাতের স্মৃতিচারণও করেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, জ্বালানি উপদেষ্টা ফৌজুল কবির খান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী সাইদুর রহমান এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তাইয়েব।