- উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষতি মানবে না ঢাকা কলেজ
- নারীশিক্ষার সঙ্কোচন চায় না বদরুন্নেসা কলেজ
- মাউশি ও ইউজিসিতে শিক্ষকদের স্মারকলিপি
ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত নানা ত্রুটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও অসন্তোষের ধানা বাঁধছে। এর আগে গত সপ্তাহে সাত কলেজের শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও পদ্ধতিগত অসঙ্গতি নিয়ে মাউশি ও ইউজিসিতে স্মারকলিপি দিয়েছে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। গতকাল অন্যতম দু’টি কলেজ ঢাকা কলেজ এবং বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছেন। সূত্র মতে ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়ে মানববন্ধন করেছেন ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্ররা। অপরদিকে স্মারকলিপি প্রদান ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রীরা। তাদের দাবি ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার (ঢাকেবি) নামে নীতিমালা বা অধ্যাদেশ জারি হলে কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো ও ঐতিহ্য নষ্ট হবে।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, সরকারের এ উদ্যোগ নারীশিক্ষার প্রসারকে ব্যাহত করবে। তারা শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা এ-সংক্রান্ত নীতিমালা বা আইন জারির প্রক্রিয়া অবিলম্বে বাতিল করার দাবি জানান। অপর দিকে গতকাল সকালে ঢাকা কলেজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা যে অস্তিত্ব সঙ্কটের আশঙ্কা করছে, তার পূর্ণাঙ্গ নিরসনের লক্ষ্যে এই মানববন্ধন করা হয়।
ঢাকা কলেজের ১৮৪ বছরের ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা হুঁশিয়ার করে বলেন, বিদ্যমান একাডেমিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন বা সঙ্কোচন যা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা তারা মেনে নেবে না। এসব বিষয় ভেবে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
গত সপ্তাহে ঢাকার এ সাতটি কলেজের কয়েক শ’ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সামনে মানববন্ধন করেন এবং ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। শিক্ষকরা কলেজগুলোর জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চান না। তাদের আশঙ্কা, এই কাঠামো বাস্তবায়িত হলে কলেজগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতির মুখে পড়বে। শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ কমে যাবে, শিক্ষকদের পদ-পদবি নিয়েও জটিলতা দেখা দেবে। ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে নারীশিক্ষার সুযোগও হুমকির মুখে পড়বে। এ জন্য শিক্ষকরা বলছেন, সাতটি কলেজ ক্যাম্পাসকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেয়ার পরিবর্তে পৃথক ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো) স্থাপন করে কলেজগুলোকে এর অধিভুক্ত করা উচিত, যাতে বর্তমান ব্যবস্থা বহাল থাকে। সেক্ষেত্রে নাম ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ থাকলেও আপত্তি নেই।
একই সাথে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষ থেকেও প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে নানা মতামত তুলে ধরা হয়েছে। তারা মাউশি এবং ইউজিসিতেও স্মারকলিপি দিয়ে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত নানা ত্রুটি তুলে ধরেছেন। শিক্ষকদেরও আশঙ্কা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আড়ালে উচ্চ শিক্ষায় সঙ্কোচন ও নারীশিক্ষায় বৈষম্যের ঘটনা ঘটতে পারে। শিক্ষকরা জানান, কলেজগুলোতে আসন কমানোর ফলে দেশের বিশাল সংখ্যক সুবিধাবঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষা হতে বঞ্চিত হবে। সরকারি কলেজের গঠনগত বৈশিষ্ট্য ও অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দুই ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়।
রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গঠনের ফলে কলেজের সক্ষমতা সঙ্কোচনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে উল্লেখ করে এগুলোকে কলেজিয়েট বা অধিভুক্তমূলক কাঠামোর আওতায় রাখার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। একই সাথে শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো, গবেষণা বাজেট, আধুনিক ল্যাব, লাইব্রেরি, আবাসন ও বৃত্তি সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করাসহ পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়েছেন সরকারি সাত কলেজ শিক্ষকরা। নারীশিক্ষকরা জানান, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ দীর্ঘকাল ধরে নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রস্তাবিত সঙ্কোচন কার্যকর হলে রাজধানীতে নারীদের উচ্চশিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, তাদের প্রবেশাধিকার সঙ্কীর্ণ হবে এবং সংবিধানপ্রদত্ত সমান সুযোগের নিশ্চয়তা লঙ্ঘিত হবে।
অন্যদিকে, প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করতে দ্রুত অধ্যাদেশ জারির দাবিতে আন্দোলন করছেন ওই সব কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি খুব দ্রুত অধ্যাদেশ জারির বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে, না হলে বড় কর্মসূচিতে যাবে তারা। এ অবস্থায় এখন ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে এই ছাত্ররা বলেছে তারা সাত কলেজের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে না।
প্রসঙ্গত ঢাকার এই সাত কলেজ একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে এগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। সরকারি সাত কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত জানুয়ারিতে এই সাত কলেজকে আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করার কথা জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনকার মতো প্রতিটি কলেজে সব বিষয় পড়ানো হবে না। সাতটি কলেজকে চারটি স্কুলে (অনুষদের মতো) বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্সের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস; স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিসের জন্য সরকারি বাঙলা কলেজ এবং স্কুল অব বিজনেসের জন্য সরকারি তিতুমীর কলেজ; স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিসের জন্য কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাস নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে আর ৬০ শতাংশ ক্লাস হবে সশরীর। তবে সব ধরনের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে সশরীর।