ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, কিছু কিছু উপদেষ্টার বক্তব্য, তৎপরতা ও কার্যক্রমে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হচ্ছে। নেতাদের অভিযোগ, প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল-পদায়ন নিয়ে কিছু উপদেষ্টা পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, বিশেষ করে একটি বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে মাঠপর্যায়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার যে প্যানেল প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেখানেও একটি বিশেষ দলের লোকদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এসব ঘটনায় বিএনপি উদ্বিগ্ন। দলটি মনে করে, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থেই সরকারের উচিত নিজেদের নিরপেক্ষ রাখা। এ লক্ষ্যে এখনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো করে তাদের চরিত্র দাঁড় করানো প্রয়োজন, যাতে সরকার ও প্রশাসনের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমন অবস্থায় শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে তারা সাক্ষাৎ করবেন। সেখানে এ বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করার পাশাপাশি তাদের উদ্বেগের কথাও জানাবেন। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জুলাই জাতীয় সনদসহ সাংগঠনিক নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা এমন সব কথা বলছেন, কার্যক্রম করছেন- যাতে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে এই সরকার তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলুক কিংবা এটা নিয়ে নতুন করে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হোক, সেটা তারা চান না। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, যেহেতু নির্বাচন আসন্ন এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা সরকারের লক্ষ্য; সুতরাং সেই নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, নিজেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে সাজানো- যাতে প্রশাসনিক বা সিদ্ধান্তগ্রহণমূলক কোনো কাজ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
দলটি মনে করছে, ৫ আগস্টের পরে প্রশাসনিক যে রদবদল বা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, সেখানে একটি দলের লোকজনকে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। বৈঠকে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনিক যে নিরপেক্ষতা, সেটা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য তাদেরকে দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিগত ১৭ বছরের যে ফ্যাসিবাদী সরকার, তাদের যে প্রশাসন- সেখান থেকে তাদের লোকজনকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরানো হয়নি; একইসাথে আরো একটি বিশেষ দলের লোকজনকেও নতুন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। জুলাই সনদ এখন স্বাক্ষরের পর্যায়ে রয়েছে। বিএনপি এই সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী ১৭ অক্টোবর সনদ স্বাক্ষরের দিন শতাধিক নেতার সমন্বয়ে গঠিত বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগদান করবে। আর দলের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বহুল আলোচিত জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবেন।
এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগের প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। মাঠপর্যায়ে তাদের যে প্রচার-প্রচারণা রয়েছে, সেখানে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে দলটি। এ ক্ষেত্রে প্রচারণায় আরো কিভাবে গতি আনা যায় এ লক্ষ্যে দলের মিডিয়া সেল ও কমিউনিকেশন সেলকে কিভাবে আরো সক্রিয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে নানামুখী অপপ্রচার চলছে, নতুন নতুন ন্যারেটিভের মাধ্যমে সেটাকে কিভাবে অ্যাড্রেস করা যায়, আলোচনা হয়েছে তা নিয়েও। একইসাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলের প্রচার-প্রচারণা আরো জোরদার করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বৈঠকে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির প্রার্থিতা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না হলেও এটা দলের একটা চলমান প্রক্রিয়া। স্থায়ী কমিটি বেশ আগেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর এই বিষয়টির দায়িত্ব দিয়েছে এবং তিনি এ ব্যাপারে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নিবেন।
নির্বাচন সামনে রেখে চলতি অক্টোবরের মধ্যেই ‘ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল’ প্রস্তুত রাখতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে। এ জন্য সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক-বীমা থেকে শ্রেণী বা গ্রেডভিত্তিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা সংগ্রহ করতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সতর্কভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে যাতে এই তালিকা প্রণয়ন করা হয়, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এ লক্ষ্যে শিগগিরই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সাথে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানাবে বিএনপি। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা চায় দলটি।