২০২৪ সালের ২৮ জুলাই রোববার। আটককৃত পাঁচ সমন্বয়ককে নির্যাতনের পর তাদের দিয়ে জোর করে ব্রিফিংয়ের ভিডিও তৈরি করে ডিবি পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় রোববার রাতে কর্মসূচি প্রত্যাহার করার সেই ভিডিওবার্তা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। প্রায় দুই দিন গোয়েন্দা হেফাজতে থাকার পর রোববার রাতে একটি খাবার টেবিলে তাদের সামনে খাবার দিয়ে ছবি তোলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ। তবে অন্য দু’জন সমন্বয়ক অভিযোগ করেন, জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে এই বক্তব্য দেয়ানো হয়েছে। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় সারা দেশে সোমবার ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ ঘোষণা করা হয়। এদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে গণগ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা ভিড় করেন ডিবি অফিসের সামনে। মা তার সন্তানের সন্ধানে, স্ত্রী স্বামীর আবার কেউ ভাইবোন ও আত্মীয়দের খোঁজ করতে ভিড় করেন ডিবি কার্যালয়ের আশপাশে। যদিও এখন পর্যন্ত ডিবির কারো সাথেই তারা দেখা করতে পারেননি। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তির জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুও ভেতরে দিতে পারেননি। তারা বলেন, কোনো ধরনের কথা না বলেই জোর করে ২০-২৫ জনের দলবদ্ধ পুলিশ বাসা, হাসপাতাল, ব্যবসা/চাকরির প্রতিষ্ঠানে ঢুকে তাদের ধরে নিয়ে আসছে। কী জন্য ধরে নেয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। কিছু জানতে চাইলে উল্টো পরিবারের লোকজনের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ বেগমও ছেলের সন্ধানে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, শুধু আমার ছেলেকে নয়, আটক সব ছেলে মেয়েদের যেন ছেড়ে দেয়া হয়। এটা কোনো নিরাপত্তা হতে পারে না। তাদের চিকিৎসা চলছে। আমরা খুবই চিন্তিত। যদি তাদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য হেফাজতে নেয়ার প্রয়োজন ছিল, তাহলে তো পুলিশ হাসপাতালেই তাদের নিরাপত্তা দিতে পারত। নাহিদকে হেফাজতে নেয়ার পর এখন পর্যন্ত আমাদের কিছু জানানো হয়নি। আমি চাই আমার ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিক। এর আগে তুলে নিয়ে নাহিদকে নির্যাতন করা হয়েছে। এখনো ক্ষতস্থান সারেনি। শরীরে জ্বর রয়েছে। তার মধ্যে আবার হাসপাতাল থেকে তাকেসহ আরো দু’জনকে তুলে নেয়া হয়েছে। নাহিদের এক ফুপু বলছিলেন, সর্বশেষ আমি নাহিদকে হাসপাতালে দেখে এসেছিলাম। তখন নাহিদের পায়ের ক্ষতগুলো বাজে অবস্থায় ছিল। নাহিদের শারীরিক অবস্থা ভালো না। গায়ে জ্বর ও পায়ে প্রচণ্ড ব্যথার কারণেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল।
সেদিন দুপুরে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছিলেন, যাদেরকে নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা নিয়ে এসেছি, তাদের পরিবারের কাছে অনুরোধ করব, দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমরা মনে করি তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা দেখছি। তাদের পরিবার যেন নিশ্চিন্ত থাকে, সেই বিষয়ে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন এবং অনলাইন-অফলাইনে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে। এই দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলা হয় অগ্নিঝরা প্রতিবাদ। তবে রাজধানীতে দেয়াল লিখনের সময় পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয় তাদের। ২৮ জুলাই রাজধানীর পলাশীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি কর্মসূচি পালন করেন কার্টুনিস্ট এবং চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তবে পুলিশি বাধায় তাদের ওই কর্মসূচি আর শেষ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পুলিশ তাদের রঙতুলি জব্দ করে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি করা হয়। দেয়ালগুলোর গ্রাফিতিতে ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন?’, ‘আমার ভাইদের মারলি কেন?’, ‘সেভ দ্য কান্ট্রি জয়েন দ্য ফাইট’, ‘পুলিশি হত্যার বিচার চাই’, ‘একদিকে নাটক করে, অন্যদিকে গুম করে’, ‘৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি’, ‘সম্পদের হিসাব পরে লাশের হিসাব আগে’, ‘হামার বেটাক মারলু ক্যান’ ইত্যাদি লেখা হয়।
ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের কয়েকজনের পরিবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলেও তাদেরকে পরিবারের সাথে দেখা করতে দেয়নি। এদিন ভোরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয়। রোববার ভোরে আটক করা হয় নুসরাতকে। মিরপুরের একটি বাসার গেট ভেঙে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
দেশে মোবাইলফোনে ইন্টারনেট সেবা ১০ দিন বন্ধ থাকার পর ২৮ জুলাই চালু করা হয়। তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বিভিন্ন সেবা বন্ধ রাখা হয়। বিকেল ৪টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে নেয়ার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সমাবেশ-বিক্ষোভ করে। তারা অবিলম্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মুক্তির দাবি জানায়।
রাত ১১টার দিকে সমন্বয়কদের জিম্মি ও নির্যাতন করে বিবৃতি দেয়ানোর প্রতিবাদে পরদিন ২৯ জুলাই আবারো রাজপথে আসার ঘোষণা দেয় দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং গণমাধ্যমসহ কিছু আন্তর্জাতিক অংশীদারের উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টি সরকার লক্ষ করেছে। বিশেষ করে অপপ্রচার, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তির ব্যাপক প্রচারের প্রেক্ষাপটে অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কৃতজ্ঞ।
কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সঙ্ঘাত-সহিংসতা ও সঙ্কট শান্তি পূর্ণভাবে নিরসনের জন্য বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কারফিউ জারি ও নাশকতাকারীদের গুলি করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন ডোনাল্ড লু। তিনি বলেন, গুলির নির্দেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রের মাধ্যমে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আহতদের দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজখবর নেন। এর আগে সকালে গণভবনে আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ ৩৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
এদিকে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত থাকে। সব মিলিয়ে ২৮ জুলাই পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ১০ হাজার ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই দিন রাজধানীতে সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় আরো ২২টি মামলা হয়। এ নিয়ে রাজধানীতে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৯ এবং গ্রেফতার সংখ্যা দাঁড়ায় দু’ হাজার ৭৬৪ জনে। ওই দিন সচিবালয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছেন।