বুয়েটে স্বজনপ্রীতি-স্বেচ্ছাচারের বিচিত্র ঘটনা

ভিসির ঘনিষ্ঠদের ‘অশুভ সিন্ডিকেট’-এর বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকের ক্ষোভ বিস্ফোরণ

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition
বুয়েটের একটি প্রবেশপথ
বুয়েটের একটি প্রবেশপথ |সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) যে প্রতিষ্ঠানটি দেশের সর্বোচ্চ প্রকৌশল শিক্ষার মানদণ্ড হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও মেধানির্ভর নিয়োগ প্রক্রিয়ার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, সে প্রতিষ্ঠানে এবার স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার একের পর এক অভিযোগে তীব্র অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।

কেন্দ্রে আছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ.বি.এম বদরুজ্জামান এবং তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ে গঠিত কথিত একটি ‘অশুভ সিন্ডিকেট’। শিক্ষকদের অংশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাংশ এবং এলামনাইদের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যেই প্রকাশ্যে উদ্বেগ জানাতে শুরু করেছেন।

যন্ত্রকৌশল বিভাগে ‘নিয়োগ কারচুপি’: এক বিজ্ঞপ্তি দুই সংস্করণ

যন্ত্রকৌশল বিভাগ (এমই)-এর লেকচারার নিয়োগই বর্তমানে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু। ২৩ জুলাই প্রকাশিত ঘোষণায় চারটি লেকচারার পদের বিজ্ঞপ্তি ছিল; কিন্তু মাত্র ছয়দিন পর ২৯ জুলাই একই রেফারেন্স নম্বর ও একই তারিখ রেখে, পদসংখ্যা গোপনে বৃদ্ধি করে পাঁচটি করা হয়।

কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা ‘প্রযুক্তিগত সংশোধন’। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ‘সংশোধনের প্রয়োজন হলে তার উল্লেখ গোপন রাখা হলো কেন?’

বুয়েটের একজন জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ‘একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে আগের তারিখ বসানো মানে প্রক্রিয়া আড়াল করা। এর পেছনে উচ্চপর্যায়ের চাপ ছাড়া এমনটি হওয়া সম্ভব নয়।’

অভিযোগের কেন্দ্র : ডিনের ছেলের প্রয়োজনেই বাড়ানো হলো পদসংখ্যা?

অনুসন্ধানে জানা গেছে ১৯ ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী, যার মেধা অবস্থান ছিল সপ্তম, ডিন অধ্যাপক ড. জহুরুল হকের ছেলে। তার আগে থাকা দু’জন ইতোমধ্যে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় চলে গেছেন। ফলে চারটি পদ হলে তিনি সুযোগের বাইরে, কিন্তু পাঁচটি পদ হলে তিনি তালিকায় উঠে আসেন।

অভিযোগ ওঠে ‘ডিনের ছেলে নিয়োগ নিশ্চিত করতেই পদসংখ্যা গোপনে পাঁচ করা হয়েছে।’

অভিযোগ প্রমাণ না হলেও ঘটনাক্রম ও সুবিধাভোগী ব্যক্তি- দুয়ের মিল ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সন্দেহ আরো গভীর করেছে।

ন্যানোমেটেরিয়ালস ও সিরামিক বিভাগে যোগ্যতা বিতর্ক :‘অযোগ্যদের এন্ট্রি’

এ ঘটনাতেই শেষ নয়। ন্যানোমেটেরিয়ালস ও সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং (এনএমএসই) বিভাগে নতুন দু’জন লেকচারার নিয়োগ নিয়েও অভিযোগ বিস্ফোরিত হয়েছে।

  • একজন যন্ত্রকৌশল বিভাগের ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট,
  • আরেকজন বস্তু ও ধাতবকৌশল (এমএমই) বিভাগের কম সিজিপিএ-ধারী, যিনি ক্যাম্পাসে পরিচিত একজন শিক্ষকের স্ত্রী হিসেবে।

একাধিক অধ্যাপক জানান ‘ন্যানোমেটেরিয়ালস বা সিরামিক কৌশল পড়ানোর জন্য যন্ত্রকৌশলের ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট কোনোভাবেই যোগ্য নন। এখানে বিশেষায়িত ব্যাকগ্রাউন্ড জরুরি; কিন্তু যোগ্য প্রার্থীরা বাদ পড়ে গেছেন।’

তাদের ভাষ্য এটি ‘একটি স্পষ্ট স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার।’

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে বিশৃঙ্খলা- ‘বাইরের পরীক্ষার কমিশন ব্যবসায় ব্যস্ত’ অভিযোগ : ভিসির ঘনিষ্ঠতার কারণে নিয়োগ পাওয়া বলে পরিচিত নতুন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই একাধিক মারাত্মক অনিয়ম সামনে এসেছে।

সাম্প্রতিক টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে- একটি বিষয়ে অর্ধেক প্রশ্নপত্র ছাপা হয়েছে, বাকি অর্ধেক ছাপা হয়নি। বুয়েটের ৬০ বছরের ইতিহাসে এরকম নজির নেই।

অভিযোগ- পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস বাইরের চাকরি বা ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করে কমিশন আদায়ের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে নিজেদের মূল দায়িত্ব উপেক্ষিত হচ্ছে।

৫ ডিসেম্বর ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বুয়েটের নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্তও বিতর্কিত হয়েছে। বুয়েট অতীতে কখনো ক্যাম্পাসের বাইরে ভেনু ভাড়া করে পরীক্ষা নেয়নি; যা ‘অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নতুন সিন্ডিকেটের ইঙ্গিত’- বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষক।

ভিসিকে সতর্ক করা হলেও ‘নীরব অবস্থান’- শিক্ষক সমিতিও নিষ্ক্রিয় : অভিযোগ রয়েছে- বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে একাধিক শিক্ষক ও সিনিয়র অ্যালামনাই ভিসিকে সরাসরি সতর্ক করেছেন। কিন্তু কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।

শিক্ষক সমিতিকে বহুবার লিখিত-মৌখিক অনুরোধ জানানো হলেও তারাও এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম বা ক্যাম্পাসে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

শিক্ষকদের মতে, ‘ভিসির চারপ াশে গড়ে ওঠা স্বজনপ্রীতির সিন্ডিকেট এখন এতটাই শক্তিশালী যে শিক্ষক সমিতি কার্যত অচল।’

ভিসির চার পাশে ‘অশুভ সিন্ডিকেট’- বুয়েটের ঐতিহ্য হুমকির মুখে

বিভিন্ন বিভাগে একযোগে নিয়োগ কারচুপি, নন-ডোমেইন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে শিক্ষক নেয়া, প্রশ্নপত্র ছাপায় অনিয়ম, বাইরের পরীক্ষায় অতিরিক্ত ব্যস্ততা- সব কিছু মিলিয়ে একটি প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে।

অভিযোগ- একটি স্বজনপ্রীতিমূলক সিন্ডিকেট ভিসির কাছাকাছি অবস্থান করে বুয়েটের নিয়োগ, পরীক্ষা এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে অস্বাভাবিক প্রভাব খাটাচ্ছে।

এই সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগী মূলত-

  • ভিসির ঘনিষ্ঠ শিক্ষকবৃন্দ
  • তাঁদের আত্মীয়স্বজন
  • রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকা কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা

বুয়েটের সিনিয়র অ্যালামনাইদের মন্তব্য, ‘বুয়েটের বিশ্বাসযোগ্যতা মুখ থুবড়ে পড়ছে। ভিসি যদি এখনই কঠোর অবস্থান না নেন, সামনে আরো বড় সঙ্কট তৈরি হবে।’

সংশ্লিষ্ট অনেকের প্রশ্ন বুয়েট কি বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে, নাকি হারাতে বসেছে অতীত ঐতিহ্য?

বাংলাদেশের প্রকৌশল খাতে উচ্চশিক্ষার অগ্রদূত প্রতিষ্ঠান বুয়েট এখন প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অ্যালামনাইদের ভাষ্য- এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বুয়েটের একাডেমিক মান, নিয়োগের সুনাম এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা- সবই হুমকির মুখে পড়বে।

তারা প্রধান উপদেষ্টাসহ রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কাছে দাবি জানিয়েছেন, ‘বুয়েটে চলমান নিয়োগ-পরীক্ষা-প্রশাসনিক অনিয়মের স্বাধীন তদন্ত হোক এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক।’