মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (সিটিসি) ড. মো: গোলাম রব্বানীকে গত বুধবার চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এবার দুর্নীতিগ্রস্ত এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ডা: মো: জসিম উদ্দিনও বরখাস্ত হচ্ছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার জসিম উদ্দিনকে প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্প এলডিডিপির কার্যক্রম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরবর্তী এক বছরেও দুর্নীতিমুক্ত হতে পারেনি। প্রকল্পের যন্ত্রসহ বিভিন্ন কেনাকাটা ও বিতরণে অনিয়ম এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন পিডি জসিম উদ্দিন। এডিবি অর্জনে ব্যর্থতা রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতার জন্য গত ৮ জুলাই পিডি জসিম উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সাবেক সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো: তোফাজ্জল হোসেন। নোটিশে বলা হয়, ডা: জসিম উদ্দিন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে গত ৩০ জুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক অগ্রগতির যে তথ্য প্রদান করেছেন তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা ও বিভিন্ন সময় প্রদত্ত দিকনির্দেশনার পরও পিডির হতাশাজনক কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নে সার্বিক অগ্রগতি বাধাগস্ত করেছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরো বলা হয়, ‘উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত সুষ্ঠু ব্যবহার করে যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণকে উপযুক্ত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে প্রকল্প পরিচালক মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আপনি কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সময়মতো বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম, গ্রহণ না করে প্রকল্প বাস্তবায়নে অবহেলা প্রদর্শন করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়।’
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসঙ্গত আদেশ অমান্যকরণ; কর্তব্যে অবহেলা প্রদর্শন এবং আইনসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র এবং নির্দেশ অবজ্ঞাকরণের সামিল যা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ এর বিধির ৩(খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ এর পর্যায়ভুক্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায় পিডি জসিমের বিরুদ্ধে অসদাচরণের দায়ে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার জবাব পত্র প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, পিডি জসিম উদ্দিন ইতঃমধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হতে পারে। নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, তিনি যেহেতু তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা তাই তার ফাইলটি এখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে রয়েছে। তার স্বাক্ষরের পরই পিডি জসিমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ হতে পারে। সেটা আজ বা কালের মধ্যেই হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে (২০২০) প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পটি (এলডিডিপি) গ্রহণ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পটির বেশির ভাগ টাকা আসছে বিশ্বব্যাংক থেকে। ঋণের টাকায় পরিচালিত প্রকল্পটির কর্মকর্তারা শুরু থেকেই দুর্নীতি অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, পশু-পাখির উৎপাদনশীলতা ও সর্বোপরি খামারিদের ভাগ্যোন্নয়ন মূল উদ্দেশ্য থাকলেও ভাগ্যবদল হয়েছে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও বিগত সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী মহলের। লুটপাটের এই প্রকল্পের শুরু থেকেই মূল ভূমিকায় ছিলেন প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর (সিটিসি) ড. মো: গোলাম রব্বানী। গত বুধবার তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের পিডি ডা: মো: জসিম উদ্দিনকে গত বৃহস্পতিবার তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মহাখালী-এর পরিচালক (গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও ম্ল্যূায়ন) ড. মো: মোস্তফা কামালকে পিডির অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।
শেখ হাসিনার পতনের প্রায় দুই মাসের মাথায় গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আগের পিডিকে সরিয়ে জসিম উদ্দিনকে পিডি নিয়োগ করা হয়। এর আগে তিনি প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আরেক প্রকল্প ‘কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং ভ্রুণ স্থানান্তর প্রযুক্তি বাস্তবায়ন’ প্রকল্পের পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রকল্পটি গত বছরের জুন মাসে শেষ হয়। জসিম উদ্দিনকে পিডি নিয়োগের পর ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। কারণ, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের ঠিক আগের দিন রাজধানীর খামারবাড়ির প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সামনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কথিত শান্তি সমাবেশে স্লোগান তুলেছিলেন এই কর্মকর্তা। সেদিন বঙ্গবন্ধু ভেটেরিনারি পরিষদের ব্যানারে হাসিনা সরকারের পক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ছাত্র-জনতাকে ‘সন্ত্রাসী, জামায়াত-শিবির রাজাকার’বলে স্লোগানের নেতৃত্ব দেয়াদের অন্যতম ছিলেন জসিম উদ্দিন। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার পতনের পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জসিমকে প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের ‘এলডিডিপি’পিডি কাদের পরামর্শে দেয়া হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনাকালে এই প্রকল্পটি শুরু হয়। শ. ম রেজাউল করীম ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয় প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা। যার বেশির ভাগই লুটপাট হয়েছে বলে তখন গণমাধ্যমে উঠে আসে। প্রকৃত খামারিরা এই প্রকল্পের তেমন কোনো সুফলই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। এ ছাড়া, অনেক প্রতারক খামারি সেজে প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা করেছেন বা করছেন প্রকল্পেরই কয়েকজন কর্মকর্তা। বিনিময়ে তারা আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন।
জানা যায়, এলডিডিপি প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে ম্যাচিং গ্র্যান্ট (অনুদান) বাবদ। অফেরতযোগ্য এই অর্থ প্রতিষ্ঠান আধুনিকায়নে ব্যয় করবেন খামারিরা-এমন শর্ত রয়েছে। ছোট খামারিরা ম্যাচিং গ্র্যান্টের টাকা ও নিজস্ব অর্থায়নে মিষ্টি তৈরির মেশিন, দই ইনকিউবেটর, মিক্সার মেশিন, দুধ ঠাণ্ডাকরণ যন্ত্র, প্যাকিং মেশিন, লাবাং মেশিন, পাস্তুরাইজার মেশিন, এস এস চুলা কেনার শর্তে অনুদান পাবেন। প্রকল্প থেকে অনুদান পাওয়া তালিকা ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, অনুদান পাওয়া এসব ব্যক্তির বেশির ভাগই খামার বা দুগ্ধজাত প্রতিষ্ঠান নেই। প্রতারণার মাধ্যমে অনেকেই অনুদানের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃত খামারিদের ভাগ্যোন্নয়ন না হলেও অসাধু কর্মকর্তা ও তাদের কমিশন দিয়ে সুবিধা নেয়া কিছু মানুষের ঠিকই পকেট ভারী হচ্ছে।
জানা যায়, গত ১৪ সেপ্টেম্বর রংপুরের আরডিআরএস বেগম রোকেয়ার মিলনায়তনে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) বিভাগীয় অগ্রগতি পর্যালোচনা কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। কর্মশালায় প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলেন ড. মো: গোলাম রব্বানী। শুরুতেই স্লাইডে শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভেসে ওঠে। অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরসহ মন্ত্রণালয় ও রংপুর বিভাগের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনার পর ড. মো: গোলাম রব্বানীকে বরখাস্ত করা হয়।
খাত সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, পিডি জসিমের বিরুদ্ধে আগের প্রকল্পেও অনিয়ম দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। এলডিডিপির পিডি হওয়ার পর সেই ধারাবাহিকতায় চলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে একাধিক তদন্ত করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।