মাদকের গডফাদার জাহেরের বাড়ি ঘিরে সিসি ক্যামেরা

রৌমারী সীমান্তে চোরাচালান

জাহের উদ্দিন ওরফে ফকির সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়ে নিবিড় মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই গ্রামে সন্দেহজনক কারো আনাগোনা টের পেলে দ্রুতই মাদক বা অবৈধ সবকিছু নিরাপদস্থানে সরিয়ে ফেলা হয়।

এস এম মিন্টু

Location :

Rowmari
Printed Edition
মাদককারবারি জাহেরের বাড়িতে রয়েছে সিসি ক্যামেরা
মাদককারবারি জাহেরের বাড়িতে রয়েছে সিসি ক্যামেরা |নয়া দিগন্ত

  • নিরাপত্তা সিন্ডিকেট সদস্যদের মাসে বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পরও গ্রেফতার নেই

দেশের উত্তরাঞ্চলে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার খাটিয়ামারী। সেখানে দীর্ঘদিন যাবৎ নিরাপদ সিন্ডিকেট গড়ে তুলে মাদক কারবার ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন জাহের উদ্দিন ওরফে ফকির। রৌমারী ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে ১০টি মাদকের মামলা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে খুঁজেই পান না। তাদের অভিযানের আগাম তথ্য পেতে সীমান্তবর্তী এই গ্রামজুড়ে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর সদস্যদের মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়েও তাকে ধরা তো দূরের কথা, ধারে কাছেও যেতে পারেনি।

গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, ভারত থেকে ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ নেশাজাতীয় দ্রব্য সুকৌশলে সীমান্ত দিয়ে আনার পর সেগুলো বাড়িতে মজুদ করা হয়। এরপর সুযোগ মতো তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। একইভাবে মিয়ানমার থেকে যেসব ইয়াবা বা ক্রিস্টাল মেথ (আইস) বাংলাদেশে ঢুকছে সেগুলোও কয়েক হাত ঘুরে ভারতে পাচারের জন্য উত্তরাঞ্চলের ওই ধরনের আস্তানায় রাখা হচ্ছে। বলতে গেলে এসব আস্তানা ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাহের উদ্দিন ওরফে ফকির সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়ে নিবিড় মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই গ্রামে সন্দেহজনক কারো (সংস্থা বা বাহিনীর) আনাগোনা টের পেলে দ্রুতই মাদক বা অবৈধ সবকিছু নিরাপদস্থানে সরিয়ে ফেলা হয়। এসব কারণে রৌমারী সীমান্তে গোয়েন্দারা মাদকের গডফাদার জাহের উদ্দিন ফকিরের বাড়ির সন্ধান পেলেও সেখানে গিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না।

গোয়েন্দারা জানান, রৌমারী থেকে জামালপুর-শেরপুর নৌরুট ব্যবহার করে ঢাকায় মাদকের চালান সরবরাহ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কুড়িগ্রামের রৌমারী এলাকার সীমান্ত পিলার ১০৬৩/২-এস থেকে আনুমানিক ৫০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জাহের উদ্দিনের টিনশেডের নিজ বাড়ি রয়েছে।

ওই বাড়ি থেকেই সব ধরনের অবৈধ মাদক কারবার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নির্বিঘেœ মাদক কারবার চালাতে বাড়ির চার পাশে বাড়ির চার পাশ, টয়লেট, এমনকি গাছের মধ্যেও ১৫ থেকে ২০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে রেখেছে জাহের। তার মধ্যে কিছু ক্যামেরা সীমান্তের দিকে মুখ করে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে বাড়ি থেকেই ৫০ গজ দূরে সীমান্ত এলাকা পর্যবেক্ষণ করা যায়। বাড়িতে মনিটরিং প্যানেল বসিয়ে ফুটেজ দেখে অবৈধ মালামাল ভারত থেকে চোরাচালান করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি চক্রের সদস্যদের দেয়া হয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।

ফলে একাধিকবার জাহেরকে ধরেতে ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়েও রৌমারী থানা পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে।

ওই অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসানুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, সীমান্তের কাছাকাছি সিসি ক্যামেরা দিয়ে মাদক কারবারের ওই তথ্য আমাদের কাছেও রয়েছে। ওই মাদক কারবারিকে আমাদের নজরদারির মধ্যে রেখেছি।

তিনি আরো বলেন, সীমান্ত এলাকায় এক শ্রেণীর মানুষ আছেন, যারা মাদকসহ নানা চোরাচালানে জড়িত। অনেক সময় তারা বড় সিন্ডিকেট বা নেটওয়ার্ক গড়ে এসব অপকর্মের চেষ্টা করে থাকেন।

বিজিবি সীমান্ত এলাকায় এ বিষয়ে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রেখে কাজ করে যাচ্ছে।

আর কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার (এসপি) মাহফুজুর রহমান জানান, এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় পুলিশ সেখানে গিয়েও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। মাদকের ওই সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলক, পুলিশ তাদের গ্রেফতার করবেই।

জানা গেছে, সম্প্রতি পারিবারিক এক ঘটনায় সৎ মায়ের সাথে বিরোধ হয় জাহের আলীর। পুলিশ তাকে ধরতে এলে সে পুলিশের কাছে তথ্য দেয়ার জন্য মাকে সন্দেহ করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে মায়ের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে তাকে অন্যত্র থাকতে বাধ্য করেন। পরে মা-ছেলের মধ্যে সমঝোতা হয় এবং মা জায়েদা বেগমকে আবার নিজ ঘরে উঠতে দেয়া হয়।

এ দিকে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের ঘুমধুম অঞ্চলের সীমান্তসহ সাগরপথে প্রতিনিয়ত বড় বড় ইয়াবার চালান ঢুকছে বাংলাদেশে।

স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, টেকনাফের হ্নীলা ইউপির আলীখালী এলাকার হারুন (কিছু দিন আগে যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেফতার), রঙ্গীখালীর শাহ আজম, মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনা এলাকার ফয়সাল প্রকাশ, চৌরঙ্গবাড়ির ফয়সাল, হ্নীলার সাইফুল প্রকাশ ওরফে আতর সাইফুল, হ্নীলা পশ্চিম সিকদার পাড়ার মোস্তাক প্রকাশ ওরফে ডিবি মোস্তাক ওরফে সোর্স মোস্তাক, লেদার জাহাঙ্গীর ও বোরহান, পালংখালী বটতলী এলাকার আবুল ফয়েজ এবং হ্নীলা ইউপির ফুলের ডেইল এলাকার আবু তালেবের বিরুদ্ধে সিসি ক্যামেরা, সোর্স বা পাহারাদার বসিয়ে ইয়াবার কারবার চালানোর জোরালো অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা অনেকেই এসব তৎপরতা দেখলেও চক্রের ভয়ে মুখ খোলেন না। এসব মাদককারবারি বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। কিন্তু অল্প দিনেই জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক কারবারে সক্রিয় হন।

এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে কক্সবাজারের এসপি মো: সাইফউদ্দিন শাহীন বলেন, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা মাদকের বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মাদকের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। জিরো টলারেন্স নীতিতে পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করছে।