তত্ত্বাবধায়ক মোডে গেলে থমকে যাবে সংস্কার : ড. দেবপ্রিয়

Printed Edition

সিলেট ব্যুরো

বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধায়ক ধাঁচের সরকারের হাতে গেলে তা গতি হারাবে বলে সতর্ক করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো, অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিলেটে সিপিডির উদ্যোগে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের প্রাক-নির্বাচনী আঞ্চলিক পরামর্শ সভায় তিনি বলেন, এ সরকার কিছু সংস্কার শুরু করেছে, কিন্তু সব সম্পন্ন করতে পারবে না। এখন যদি সরকার তত্ত্বাবধায়ক মোডে চলে যায়, তাহলে সংস্কার উদ্যোগগুলো আরো ধীর হয়ে পড়বে। তিনি আরো বলেন, সংস্কারের প্রতি যে উৎসাহ শুরুতে দেখা গিয়েছিল, তা এখন অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছে। এখন দরকার নতুন এক রাজনৈতিক ঐকমত্য-যার ভিত্তিই হবে সংস্কার।

ড. দেবপ্রিয় জোর দিয়ে বলেন, গণতন্ত্র ছাড়া জবাবদিহি আসে না। জবাবদিহির অনুপস্থিতিতে সরকারগুলো তথাকথিত ‘দৃশ্যমান উন্নয়ন’-এর পথে যায়- যা সাধারণত ঋণনির্ভর হয় এবং শিা ও স্বাস্থ্য খাতকে উপো করে। তিনি বলেন, রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের একধরনের গোষ্ঠী এ দৃশ্যমান উন্নয়ন মডেল থেকে লাভবান হয়েছে। তারা স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করে না, কারণ স্বচ্ছতা প্রতিযোগিতা আনে, আর প্রতিযোগিতা তাদের আধিপত্যকে হুমকিতে ফেলে। এ ব্যবস্থাকে তিনি আখ্যা দেন কায়েন্টেল বা প্রভাবশালী পুঁজিবাদ হিসেবে, যা সময়ের সাথে ‘লুণ্ঠনের সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার সংস্কার-দৃষ্টি এগোয়নি : ড. দেবপ্রিয় বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সংস্কার-আকাক্সা ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশিতভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার উদ্যোগে উদ্দীপিত ছিলেন-অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে টাস্কফোর্স গঠন পর্যন্ত। কিন্তু তার দল ও প্রশাসন সেটি এগিয়ে নিতে পারেনি, বলেন তিনি। তার মতে, ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ইশতেহারে চলমান সংস্কার প্রতিশ্রুতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যেন পরবর্তী সরকার এগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়তে এবং মধ্যম আয়ের পথে এগোতে এ সংস্কারগুলো অপরিহার্য। তিনি আরো বলেন, সব কিছু এ সরকারের পে করা সম্ভব নয়। সরকারকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে- কোন সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে, কোনটি চলমান, আর কোনটি অসম্পূর্ণ। ভবিষ্যৎ ইশতেহারে এসবের দিকনির্দেশনা থাকতে হবে।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক খাতের প্রতিনিধিরাও নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।

শিা-গুণগত উন্নয়ন ছাড়া স্থায়ী অগ্রগতি নয় : সভায় মূল প্রবন্ধে ড. দেবপ্রিয় উল্লেখ করেন, অতীতে বাংলাদেশের উন্নয়ন ছিল মূলত দৃশ্যমান বা অবকাঠামোগত ‘স্কুল-কলেজ ভবন নির্মাণ হয়েছে, কিন্তু শিক বা শিার মান উন্নয়ন হয়নি।’ তার দাবি, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময়ে একটি গোষ্ঠী এ দৃশ্যমান উন্নয়ন থেকে সুবিধা নিয়েছে এবং এর মধ্য দিয়েই দেশে ‘কায়েন্টেল পুঁজিবাদী অর্থনীতি’ গড়ে উঠেছে। ‘সংস্কার প্রণয়ন অনেক সহজ, কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন,’ বলেছেন ড. দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘যারা ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করবে, তাদের প্রকৃত সংস্কারমনা হতে হবে। বর্তমান সরকার অন্তর্বর্তীকালীন হলেও এটি এক রূপান্তরের সময় যা আমাদের এগিয়ে নিতে হবে।

নতুন আশার সূচনা : সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সভায় বলেন, অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু আমরা আশাবাদী-আমাদের ভবিষ্যৎ অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না। গত বছরের জুলাই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা এক নতুন পর্বে প্রবেশ করেছি। তিনি জানান, সিপিডি এ ধরনের আঞ্চলিক পরামর্শ সভা থেকে সংগৃহীত মতামত নিয়ে একটি নাগরিক ইশতেহার প্রণয়ন করবে।

চামচা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে লুটপাট ও চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত : নাগরিক প্ল্যাটফর্মের পরামর্শ সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার স্বপ্ন ও আকাঙ্খা তার সহযোগী ও আমলাতন্ত্র এগিয়ে নিতে পারেনি। তিনি বলেন, দেশে ‘চামচা পুঁজিবাদী’ অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, যেখানে কিছু সুবিধাভোগী রাষ্ট্রের কাঠামো ব্যবহার করে লুটপাট ও চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এ গোষ্ঠী সব সময়ই সংস্কারবিরোধী। ড. দেবপ্রিয় বলেন, আগামী দিনের নির্বাচনী ইশতেহারে সেই প্রতিশ্রুতিগুলোকে স্থান দিতে হবে, যার ধারাবাহিকতা নতুন সরকার রা করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে এবং দেশকে মধ্যম আয়ের স্তরে নিতে হলে এ সংস্কারগুলো অপরিহার্য।