গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বাঁশ শিল্প বিলীনের পথে

ডুমুরিয়ায় বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম অবস্থা

Printed Edition
ডুমুরিয়ায় বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম অবস্থা
ডুমুরিয়ায় বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম অবস্থা

আনোয়ার হোসেন আকুঞ্জী ডুমুরিয়া (খুলনা)

গ্রামবাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রতীক বাঁশ শিল্প আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এক সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে বাঁশের তৈরি কুলা, চালনি, ঝুড়ি, খাঁচা, ডোলা, পলো, চাটাই কোনোটাই অপ্রয়োজনীয় ছিল না। বাঁশের ডোল না থাকলে ধান রাখা যেত না, কুলা ছাড়া চাল বাছাই হতো না, এমন ছিল সেই সময়ের বাস্তবতা। অথচ আজ প্লাস্টিক, লোহা ও ফাইবারের পণ্যের দাপটে সেই ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছে দ্রুত।

খুলনা ডুমুরিয়া উপজেলার মধুগ্রামসহ আশপাশের অঞ্চলে একসময় দাস বা ঋষী সম্প্রদায়ের প্রায় ৩৭টি গ্রামের মানুষ বাঁশ শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন সেই সংখ্যা কমে মধুগ্রামে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ পরিবারে। একদা প্রাণচঞ্চল এই শিল্প আজ নিস্তব্ধ, কর্মহীন শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

বাঁশশিল্পী রবীন্দ্রনাথ দাস (৪৮) বেদনাক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি, কিন্তু এতে সংসার চলে না। বাঁশের দাম বাড়ে, আমাদের পণ্যের দাম বাড়ে না। মেয়ের পড়াশোনা, সংসারের খরচ, সব সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।’

গোপাল দাস (৬৫) জানান, ছেলেরা এ পেশায় আসতে চায় না, কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে। শুকুমার দাস (৪৩) বলেন, ‘আগে দিনে ১৫-২০টা ঝুড়ি বিক্রি হতো। এখন দুইটা বিক্রি করলেও লাভ থাকে না। বাজার দখল করেছে প্লাস্টিক।’

এই পেশার প্রতি শেষ ভরসা ধরে রাখা শিক্ষিত তরুণ সুদেব দাস (৩৮) বলেন, ‘এমএ পাস করেছি, চাকরি হয়নি। তাই ফেরত এসেছি পূর্ব-পুরুষের পেশায়। কিন্তু অবস্থাও ভালো না।’

পরিসংখ্যান বলছে, ১৫ বছর আগেও একটি বাঁশের দাম ছিল ৮০-১০০ টাকা। এখন সেই বাঁশই ২০০-৩০০ টাকা। কিন্তু বাঁশের তৈরি পণ্যের দাম বাড়েনি সেই অনুপাতে।

এতে প্রতিটি কাজেই থাকছে লোকসানের ঝুঁকি। বাধ্য হয়ে অনেকেই ভ্যান চালানো, সেলুন বা দিনমজুরির পথে চলে গেছেন।

শোলগাতিয়া গ্রামের বিক্রেতা পঞ্চানন দাস (৬৬) বলেন, ‘ঋণ করে বাঁশ কিনি, পণ্য তৈরি করি, তাও বিক্রি নেই। তবুও বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে মন চায় না।’ স্থানীয় কবি ও সমাজকর্মী শেখ আজিজুর রহমান বলেন, ‘বাঁশ শিল্প শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি সংস্কৃতির ধারক। এই শিল্প বাঁচাতে সরকারি প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ ও বাজার ব্যবস্থা জরুরি।’

ডুমুরিয়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুব্রত বিশ্বাস জানান, অনগ্রসর এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হলেও, বাঁশশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আরো সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

বাংলার হাসি-কান্না, স্মৃতি-সংগ্রাম- সবকিছুই লুকিয়ে রয়েছে বাঁশ শিল্পের বুননে। এই ঐতিহ্য হারিয়ে গেলে শুধু একটি পেশাই নয়, হারিয়ে যাবে শেকড়সংশ্লিষ্ট এক সাংস্কৃতিক পরিচয়। এখন প্রশ্ন, সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া এই শিল্পকে বাঁচাতে আমরা কি যথাসময়ে হাত বাড়াব? নাকি নিঃশব্দেই বিলীন হবে গ্রামবাংলার এই অমূল্য উত্তরাধিকার?