কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ হঠাৎ বৃদ্ধি

রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা

নতুন কাঠামো অনুযায়ী, ২০ ফুটের কনটেইনার রফতানিতে প্যাকেজ চার্জ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯০০ টাকা, যা আগে ছিল ৬ হাজার ১২৭ টাকা। এতে খরচ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৭৭৩ টাকা বা ৬২ শতাংশ।

শাহ আলম নূর
Printed Edition

দেশের রফতানি বাণিজ্য নতুন এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে হঠাৎ করে চার্জ বৃদ্ধির কারণে রফতানি খাত বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। দেশের ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে (অফডক) বিভিন্ন সেবার চার্জ গড়ে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন এ ট্যারিফ কার্যকর হয়েছে। এ সিদ্ধান্তে রফতানিকারক ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন কাঠামো অনুযায়ী, ২০ ফুটের কনটেইনার রফতানিতে প্যাকেজ চার্জ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯০০ টাকা, যা আগে ছিল ৬ হাজার ১২৭ টাকা। এতে খরচ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৭৭৩ টাকা বা ৬২ শতাংশ। একইভাবে ৪০ ফুট কনটেইনারের চার্জ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২০০ টাকা, যা আগে ছিল ৮ হাজার ২৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ৪০ ফুট হাইকিউব কনটেইনারে, যেখানে আগের ৮ হাজার ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ টাকা, অর্থাৎ ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি।

বিশেষ ধরনের গার্মেন্ট অন হ্যাঙ্গার কার্গো (জিওএইচ কার্গো) বহনের ক্ষেত্রেও নতুন চার্জ আরোপ করা হয়েছে। আগে এসব কনটেইনারে সাধারণ রেট প্রযোজ্য হতো। এখন ২০ ফুট কনটেইনারের চার্জ ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৯০০ টাকা, আর ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য ১৫ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া রেফার কনটেইনারের প্লাগ-ইনচার্জ বেড়েছে ১৭০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকায়। খালি কনটেইনার উঠানো-নামানোর চার্জ ৫২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫০ টাকা। কনটেইনারপ্রতি ডকুমেন্টেশন চার্জ ২৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৫০ টাকা করা হয়েছে। পাশাপাশি খালি কনটেইনার পরিবহন খরচও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের রফতানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকডার এই সিদ্ধান্ত একতরফা এবং নিয়মনীতি পরিপন্থী। চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে কনটেইনারের বেশির ভাগই বেসরকারি ডিপোগুলোতে হ্যান্ডল হয়। ফলে চার্জ বৃদ্ধির ধাক্কা সরাসরি রফতানিকারকদের ওপর পড়বে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন, এক লাফে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে কোনো কমিটির মতামত ছাড়াই। বিকডা পোর্টকে মানছে না, এনবিআরকেও মানছে না, এমনকি আমাদের সাথেও কোনো আলোচনা করেনি। এতে রফতানি খাত বিপর্যস্ত হবে।

তিনি আরো বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রফতানি আগেই কমে গেছে। এখন চার্জ বাড়ানো হলে বিদেশী ক্রেতারা নিরুৎসাহিত হবেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) পক্ষ থেকে চার্জ বৃদ্ধির সমালোচনা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে অতিরিক্ত খরচ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা টিকতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বিকল্প বাজারে চলে যেতে পারেন।

বিএএফএফএ দাবি করেছে, বিকডা যেন অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। একই সাথে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে তারা। এ দিকে বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার চার্জ বৃদ্ধিকে যুক্তিসঙ্গত দাবি করে বলেন, শিপিং এজেন্টরা তাদের বিল পান ডলারে, কিন্তু আমরা পাই টাকায়। গত কয়েক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রায় ৫৫ শতাংশ কমেছে। ফলে ডলারের হিসাবে খরচ আগের মতোই আছে, শুধু টাকায় হিসাব করলে বেশি মনে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, ডিপোর যন্ত্রপাতি, ক্রেন, রেফার কনটেইনারের সরঞ্জামসহ অধিকাংশ কিছুই ডলারে আমদানি করতে হয়। ডলারের দামের সাথে সামঞ্জস্য আনতেই নতুন চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বিকডার যুক্তি একপক্ষীয় হলেও সমস্যার মূল জায়গা ডলারের অস্থিরতা। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সাইফুল আলম বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন ব্যবসায়ীদের জন্য সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে নেয়া উচিত ছিল। একতরফা পদক্ষেপ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, রফতানি খাত বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস। এ খাতে অতিরিক্ত খরচ চাপিয়ে দিলে ডলার সঙ্কট আরো বাড়তে পারে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানিকারকদের আশঙ্কা, নতুন চার্জ কার্যকর হলে বাংলাদেশী পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। বিশেষ করে পোশাক খাত, যা দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। বিদেশী ক্রেতারা যদি বিকল্প বাজার যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তা বাংলাদেশের রফতানির জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতার মুখে, সেখানে অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নেয়া কঠিন হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যাদের আর্থিক সামর্থ্য সীমিত।

ব্যবসায়ী মহল বলছে, চার্জ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক সমাধান বের করতে হবে। একই সাথে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন জরুরি। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারকারীরা আশা করছেন, সরকার এ বিষয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপ গ্রহণ করবে। কারণ দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের প্রায় ৯০ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর ও সংশ্লিষ্ট অফডকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বন্দর ও ডিপোতে সেবার মান উন্নয়ন, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে খরচ কমানো সম্ভব।

বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে চার্জ বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত এখন রফতানি বাণিজ্যের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রফতানিকারক ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা দাবি তুলেছেন, একতরফা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে সব পক্ষের মতামত নিয়ে যৌক্তিক সমাধান করা হোক। অন্য দিকে বিকডা বলছে, ডলার-টাকার ব্যবধান না মেটালে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের স্বার্থে এই জটিল সমীকরণের সমাধান দ্রুত সময়ে করতে হবে। সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে রফতানি আয় হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।