মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
খিদমত অর্থ- সেবা, কাজ, কর্ম-সার্ভিস। খিদমতে দ্বীন অর্থ দ্বীনের সেবা বা দ্বীনের কাজ। দ্বীনের পক্ষে করণীয় সব কাজই খিদমতে দ্বীনের কাজ। ইকামত অর্থ- প্রতিষ্ঠা, স্থাপন, উত্তোলন, অবস্থান। ইকামতে দ্বীন অর্থ- দ্বীন প্রতিষ্ঠা। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক সব কাজই ইকামতে দ্বীনের কাজ। এখানে দ্বীন দ্বারা ইসলাম উদ্দেশ্য। সব ঈমানদার দ্বীনের কাজ করেন। কেউ করেন খিদমতের কাজ, আবার কেউ করেন ইকামতের কাজ।
খিদমতে দ্বীন ও ইকামতে দ্বীনের মধ্যে পার্থক্য : খিদমতে দ্বীন ও ইকামতে দ্বীন উভয়ই দ্বীনের জন্য অপরিহার্য কাজ। তবে দ্বীনের প্রাথমিক কাজ হলো খিদমতে দ্বীন। আর চূড়ান্ত কাজ হলো ইকামতে দ্বীন। খিদমতে দ্বীনে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ইকামতে আসবে চরম বাধা। যদি নামাজ পড়ার আদেশ দেয়া হয়, রোজা রাখতে বলা হয়, মিসওয়াক করতে বলা হয়, জিকির করতে বলা হয়- এক কথায়, আমর বিল মারুফ যত কাজ করতে বলা হয় কেউ বাধা দেবে না। অনেক মুসলমান মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাদরাসা করেছেন, রাস্তা করেছেন, জনহিতকর অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু তারা সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, জিনা-ব্যভিচার ইত্যাদি অসংখ্য অপকর্মের সাথেও জড়িত। কেউ কেউ জিহাদ অর্থ করেছেন খেদমত। কুরআন মাজিদের সূরা তাওবার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমরা জিহাদের জন্য বের হও স্বল্প সরঞ্জামের সাথেই হোক বা প্রচুর সরঞ্জামের সাথেই হোক।’
এ আয়াতটি তাবুক যুদ্ধের প্রাক্কালে অবতীর্ণ হয়। তাবুক যুদ্ধটি হয়েছে গরমের সময় ও ফসল ঘরে তোলার মৌসুমে। তাছাড়া তা ছিল অনেক দূরের পথ এবং শক্তিশালী রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে। রোম সম্রাট মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তার বাহিনী আগাম এক বছরের বেতন দিয়েছে। উপরন্তু আরবের লাঘাম, জুষাম, আমেলা ও গাসসান গোত্রগুলোকেও সাহায্যের জন্য একত্রিত করেছে। আল্লাহ মুমিনদেরকে এ পরিস্থিতি নির্দেশ দিয়েছেন- একাকী হও বা দলবদ্ধভাবে, খুশি হয়ে অথবা অখুশি হয়ে, গরিব হও বা ধনী হও, যুবক হও বা বৃদ্ধ হও, হেঁটে হোক অথবা বাহনে জিহাদে বের হও। কিন্তু কেউ কেউ এ আয়াতকে ব্যবহার করছেন- তিন দিন, ১০ দিন বা ৪০ দিনের জন্য বের হওয়াকে। জিহাদের কোনো আলোচনাই করা হয় না। জিহাদ যেন কোনো বিষয়ই না। অথচ সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ ছিল ফুরসানুন নাহার রুহবানুল লাইল দিনের সৈনিক রাত্রে দরবেশ। মহানবী সা:-এর বাণী এক সকাল ও এক সন্ধ্যা আল্লাহর রাস্তায় অতিবাহিত করা, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সব কিছু থেকে উত্তম।’ (মিশকাত হাদিস নং-৩৮৪৯, মুসনাদ আহমদ)
এ হাদিসে জিহাদে সময়দানকে বুঝানো হয়েছে, অথচ কেউ কেউ অন্যত্র সময় দেখাকে বুঝেছেন। আপনি যদি মাটির নিচের কার্যক্রমের দাওয়াত দেন আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু পার্থিব বিষয় চালচলন নিয়ে কথা বলেন, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, ব্যভিচার, পর্দা, অন্যায়, জুুলুম, নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন তখন স্বার্থান্বেষী মহল অসন্তুষ্ট হবে, আপনার প্রতি খড়গহস্ত হবে। খিদমতে দ্বীনের কাজ যদি ইকামতে দ্বীনের সহায়ক না হয়, তবে এ ধরনের খিদমতে দ্বীনের কোনো মূল্য নেই। লম্বা পাঞ্জাবি, মুখভরা দাড়ি, মাথা উঁচু টুপি, হাতে তাসবিহ নিয়ে যদি সুদের কারবার করি, অন্যের সম্পদ গ্রাস করি, মাপে কম দেই, ঘুষ নেই, অন্যায় কাজকে সমর্থন করি তাহলে আমার পাঞ্জাবি, দাড়ি, টুপির কোনো মূল্য নেই। সর্বপ্রকার অনাচার বন্ধের জন্য যা দরকার তাহলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন কায়েম করা। রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন কায়েম করতে ইকামতে দ্বীনের কাজ খুবই কঠিন।
দ্বীনকে পৃথিবীতে কায়েম করার জন্যই নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে। খিদমতে দ্বীন বা ইবাদত-বন্দেগির জন্য ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল। মহানবী সা: যে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে বিদায় নিয়েছেন সে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করাই মুমিনের দায়িত্ব। ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করাই মুমিনের দায়িত্ব। ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা হলে মসজিদ শুধু নামাজঘর নয়, মসজিদ হবে সংসদ ভবন। সেই মসজিদে চুরির শাস্তি, ব্যভিচারের শাস্তি, মদ পানের শাস্তি ইত্যাদি প্রয়োগ করা হবে। এ মসজিদ থেকে সুদের, বেপর্দার শাস্তির ঘোষণা আসবে।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী



