২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে পালিয়ে যায় তার ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ। তারা আজও কর্মস্থলে ফিরে আসেননি। অনেকেই রয়েছেন আত্মগোপনে, কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। অথচ এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এমনকি এদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও এখনো দেয়নি বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতর।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দফতরকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হলেও কার্যকর কোনো সাড়া মেলেনি। মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী, কর্মস্থলে বিনা অনুমতিতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত। সেই অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে চাইলেও অভিযুক্তদের তালিকা না পাওয়ায় প্রশাসনিক প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে।
দুইবার চিঠি, তবু তালিকা নেই : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২৫ সালের ৮ জুলাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শককে একটি চিঠি পাঠায়, যেখানে এসএসপি ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের ‘পলায়নকারী’ কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা চাওয়া হয়। তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি, তখন ২৭ জুলাই আরেকটি তাগিদপত্র পাঠানো হয়।
দ্বিতীয় চিঠিতে বলা হয় : “দ্রুত বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ‘পলায়ন’ এর অভিযোগে অভিযুক্ত বাংলাদেশ পুলিশের এসএসপি এবং তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নামের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা এ বিভাগে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।”
তবে এখনো পুলিশ সদর দফতর থেকে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর সাড়া পাওয়া যায়নি। এতে করে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পলাতক কর্মকর্তার সংখ্যা ও পরিচয় : পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী অন্তত ৫৩ জন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পলায়নের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন : হারুন অর রশীদ (ডিএমপির ডিবির সাবেক প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার)- ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে পলাতক, বিপ্লব কুমার সরকার, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি- ৫ আগস্ট থেকে, এস এম মেহেদী হাসান, ডিএমপি- ৫ আগস্ট থেকে, সঞ্জিত কুমার রায়, অতিরিক্ত ডিআইজি- ১৫ আগস্ট থেকে, রওশানুল হক সৈকত, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার- ২৫ আগস্ট থেকে, প্রলয় কুমার জোয়ারদার, অতিরিক্ত ডিআইজি- ৬ আগস্ট থেকে, রিফাত রহমান শামীম, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি- ১৮ আগস্ট থেকে, কাজী আশরাফুল আজীম, উপ-পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি- ১৪ আগস্ট থেকে, আল ইমরান হোসেন, সহকারী পুলিশ কমিশনার, রংপুর- ১৮ আগস্ট থেকে, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিআইজি- ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে, আসাদুজ্জামান, পুলিশ সুপার- ২২ সেপ্টেম্বর থেকে, তৌহিদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১০ সেপ্টেম্বর থেকে, এস এম শামীম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে, সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার- ২২ আগস্ট থেকে, মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন, ডিএমপির সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার- ২৮ আগস্ট থেকে, মাহমুদুল হাসান, সহকারী পুলিশ সুপার- ১২ সেপ্টেম্বর থেকে, এস এম জাহাঙ্গীর হাসান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ২৪ অক্টোবর থেকে, মাসুদুর রহমান মনির, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১৩ নভেম্বর থেকে, মোহাম্মদ জায়েদুল আলম, অতিরিক্ত ডিআইজি- ১৪ নভেম্বর থেকে, মিশু বিশ্বাস, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ২৬ অক্টোবর থেকে, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন, অতিরিক্ত ডিআইজি- ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে, রুবাইয়াত জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ২৯ জানুয়ারি থেকে, শ্যামল কুমার মুখার্জি, অতিরিক্ত ডিআইজি- ২২ জানুয়ারি থেকে, আয়েশা সিদ্দিকা, বিশেষ পুলিশ সুপার- ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে, মো: শাহজাহান, পুলিশ সুপার- ১৬ জানুয়ারি থেকে, রহমত উল্লাহ চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে, হাসানুজ্জামান মোল্লা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে, মোহাম্মদ ইমরুল, সহকারী পুলিশ সুপার- ২৮ জানুয়ারি থেকে, নুরে আলম মিনা, ডিআইজি- ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে, মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার- ১ জানুয়ারি থেকে, মানস কুমার পোদ্দার, সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি- ১৮ অক্টোবর থেকে, গোলাম মোস্তফা রাসেল, নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার- ১ জানুয়ারি থেকে, আরিফুর রহমান মণ্ডল, সিরাজগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার- ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে, ইফতেখারুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে, আনিসুর রহমান, ডিআইজি- ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে, রাজীব দাশ, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার- ২ নভেম্বর থেকে, শাহ নুর আলম পাটোয়ারী, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার- ১৮ অক্টোবর থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত, আরিফুজ্জামান, সহকারী পুলিশ সুপার- ১৩ অক্টোবর থেকে, কাজী মনিরুজ্জামান, পুলিশ সুপার- ২৪ নভেম্বর থেকে, তারেক বিন রশীদ, পুলিশ সুপার-২৩ নভেম্বর থেকে, রাজন কুমার দাশ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ৩১ ডিসেম্বর থেকে, হাফিজ আল ফারুক, পুলিশ সুপার- ২ ফেব্রুয়ারি থেকে, জুয়েল চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার- ১৬ এপ্রিল থেকে, মির্জা সালাউদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার-২১ সেপ্টেম্বর থেকে, আহমেদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার- ৩ মাস ২১ দিন অনুপস্থিত, আবু মারুফ হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার ২০৫ দিন অনুপস্থিত, মনিরুজ্জামান, অতিরিক্ত ডিআইজি-১২ আগস্ট থেকে ও হাবিবুল্লাহ দালাল, সহকারী পরিচালক, পুলিশ স্টাফ কলেজ-১ ফেব্রুয়ারি থেকে পলাতক রয়েছেন।
আইনি ও প্রশাসনিক দিক : ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী, বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিতি গুরুতর অসদাচরণ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা, পদাবনতি, বেতন স্থগিত, এমনকি চাকরি থেকে অপসারণ পর্যন্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ধরনের গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবশ্য কর্মকর্তার আপিল করার অধিকার রয়েছে। তবে দীর্ঘ অনুপস্থিতির কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা না থাকলে সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা হারান বলেই আইন বলছে।
পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া : পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি এই দায়িত্বে নতুন এসেছি। বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই।’
অপর দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা তথ্য সংগ্রহ এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়ায় আছি। পুলিশ সদর দফতরকে বারবার চিঠি দিয়েছি। এখনো অপেক্ষায় আছি। আশা করছি, দ্রুতই তালিকা আসবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনিক কার্যকারিতা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষতা এবং শৃঙ্খলাবিধি রক্ষার স্বার্থে পলায়নকারী এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। তালিকা গোপন রাখা বা বিলম্বে প্রদান করা একদিকে যেমন প্রশাসনের প্রতি জনআস্থা হ্রাস করে, অন্য দিকে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও কার্যকর ফল পেতে হলে পুলিশ সদর দফতরের সহযোগিতা এখন সময়ের দাবি।